দেশে আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। কখনো অপরাধী মনে করে গণপিটুনি, কখনো প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে বা মব সৃষ্টি করে হত্যা করা হচ্ছে মানুষ। পাঁচ বছরের ব্যবধানে (২০২১-২০২৫) দেশে মব-গণপিটুনির ঘটনা বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। এতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে মাসিক গড়ে ৫.৬৭ গুণ দাঁড়িয়েছে। এ সময় আহত বেড়েছে ৩৩ গুণের বেশি। চলতি বছরের ১০ মাসেই ৩৫৬টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, যাতে প্রাণ হারিয়েছে ১৩৭ জন। গুরুতর আহত হয়েছে ৩৯০ জন। এমন পরিস্থিতি জনমনে আতঙ্ক বাড়াচ্ছে।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন প্রকাশিত এ সংক্রান্ত পাঁচ বছরের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসছে। তাদের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২১ সালে দেশে ৪৪টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। এতে ২৯ জন নিহত ও ১৪ জন আহত হন। ২০২২ সালে ১১৩টি গণপিটুনিতে ৬১ জন নিহত ও ৭৬ জন আহত হন। ২০২৩ সালে ১৪৫টি গণপিটুনিতে ৮৬ জন নিহত ও ৫৮ জন আহত হন। ২০২৪ সালে ১৬৯টি গণপিটুনিতে ১৪৬ জন নিহত ও ১২৬ জন আহত হন। ২০২৫ সালের প্রথম ১০ মাসেই ৩৫৬টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। পরিসংখ্যান বলছে, গণপিটুনির ঘটনা প্রতি বছরই বাড়ছে। তবে ২০২৫ সালে এমন ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। ২০২৪ সালে প্রতি মাসে গড়ে ১৪টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। ২০২৫ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫.৬টিতে। গত বছর প্রতি মাসে গণপিটুনিতে ১২.১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, চলতি বছরে এ সংখ্যা বেড়ে ১৩.৭ জনে দাঁড়িয়েছে। এই ধারা চলতি নভেম্বর ও আগামী ডিসেম্বরে অব্যাহত থাকলে গণপিটুনির ঘটনায় রেকর্ড গড়বে। অন্যদিকে ২০২১ সালে যেখানে প্রতি মাসে গড়ে ৩.৬৬টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছিল, ২০২৫ সালে (প্রথম ১০ মাস) তা দাঁড়িয়েছে ৩৫.৬টিতে। প্রায় ৯.৭ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সময়ে মাসিক গড় নিহত বেড়েছে ৫.৬৭ গুণ এবং আহত বেড়েছে ৩৩ গুণের বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৪ ও ২০২৫- দুই বছরই গণপিটুনিতে সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে। গত বছর এ দুই মাসে মোট ৪৪ জন প্রাণ হারান। চলতি বছর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ওমর ফারুক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মব বা গণপিটুনির এই ক্রমবর্ধমান প্রবণতা শুধু অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ব্যর্থতাই নয়, সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও একটি বড় হুমকি। মানুষ রাজনীতি, সরকার ও আইনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেললেই সমাজে এ ধরনের অপরাধ বাড়ে। এ ছাড়া বিচারহীনতার পরিবেশ জনমানসে তীব্র হতাশা তৈরি করে, যা ক্রমেই পরিণত হয় সমষ্টিগত সহিংসতায়। সাম্প্রতিক সময়ে মব ভায়োলেন্স অনেক বেড়েছে। এটা সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রতীক। এর কারণ আইনের প্রতি আস্থাহীনতা। আইন হাতে তুলে নেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। আবার এতে কারও মৃত্যু হলে সেটা হত্যাকাণ্ড, যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তবুও এমন ঘটনা ঘটছে। কারণ, যারা করছেন তারা বিশ্বাস করেন এটা করলে তাদের কিছু হবে না। গণপিটুনি বা মব ভায়োলেন্সের ঘটনাগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুষ্ঠু বিচার হয় না। তদন্তে গাফিলতি। সাক্ষী পাওয়া যায় না। অপরাধীরাও এর সুযোগ নেয়। তার মতে, এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে অপরাধের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। মব বা গণপিটুনির ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে হবে। তখন প্রমাণ করে সাজা দেওয়া সহজ হবে। সর্বপরি জনআস্থা পুনর্গঠনে জোর দিতে হবে।