রাজধানীর বনানী থানার সাবেক পরিদর্শক (তদন্ত) ও ই-অরেঞ্জের পৃষ্ঠপোষক শেখ সোহেল রানা ইউরোপের আলবেনিয়ার কারাগারে আটক আছেন। ইন্টারপোলের সহায়তায় তার অবস্থান সম্পর্কে চলতি বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে জানতে পারে বাংলাদেশ পুলিশ। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের ফাঁদে ফেলে ৫৪৭ জন গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া যায় তার বিরুদ্ধে।
জানা যায়, প্রথমে তিনি লেবাননে আটক হয়েছেন বলে জানতে পারে পুলিশ। এ ব্যাপারে কাজ শুরুর পরই আলবেনিয়ার কারাগারে আটকের তথ্যটি পাওয়া যায়। অনুপ্রবেশের দায়ে ওই দেশের আদালতে বিচার চলছে। এটি শেষ হলে তাকে দেশে ফেরানো সম্ভব হবে। ২০২৩ সালের ২৯ জানুয়ারি তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের পদক্ষেপ জানতে চান হাই কোর্ট। শুনানিতে আইজিপির প্রতিবেদন তুলে ধরে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জানিয়েছিলেন, ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করা আছে। ২০২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি পাওয়া তথ্য অনুসারে- ভারতে অনুপ্রবেশের কারণে তিনি তিন বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে প্রেসিডেন্সি কারেকশনাল হোম আলীপুরে আটক ছিলেন। জামিন নিয়ে পালিয়ে যান। জানা যায়, কাফেলো নামে পর্তুগালের এক নাগরিক সোহেল রানার বন্ধু। তার সঙ্গে যোগাযোগ করে ভারতীয় পাসপোর্ট ব্যবহার করে পর্তুগালের ভিসা নিয়ে ওই দেশে পালিয়ে যান তিনি।
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন্স) রেজাউল করিম এ প্রতিবেদককে বলেন, তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা চলছে। আলবেনিয়ায় আমাদের দূতাবাস নেই। গ্রিসের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হচ্ছে। এজন্য দেরি হচ্ছে। সূত্র জানায়, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ সদর দপ্তরের সমন্বয়ে একটি টিম আলবেনিয়ায় পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নোটারি করে গত ফেব্রুয়ারিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
সোহেল রানার ই-অরেঞ্জে পণ্য কিনে প্রতারণার শিকার হওয়া ৫৪৭ জন গ্রাহকের পক্ষে ২০২২ সালের মার্চে ছয়জন ভুক্তভোগী হাই কোর্টে রিট করেন। ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ৭ এপ্রিল হাই কোর্ট রুলসহ আদেশ দেন। ৩ নভেম্বর হাই কোর্ট কয়েক দফা নির্দেশনাসহ আদেশ দেন। আদেশে ই-অরেঞ্জ থেকে টাকা উত্তোলনকারীদের নাম-ঠিকানা উল্লেখ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসহ (বিএফআইইউ) তিন বিবাদীকে ৩০ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। শেখ সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পদক্ষেপ নিতে এবং তার বিষয়ে অগ্রগতি হলফনামা করে জানাতে স্বরাষ্ট্র সচিবকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালের ২৯ জানুয়ারি হাই কোর্টে আইজিপির প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।
পুলিশ বলছে, সোহেল রানার বিরুদ্ধে ৯টি মামলা রয়েছে। তাকে ফিরিয়ে আনতে ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত পুলিশ সদর দপ্তর ভারতের সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে চিঠি চালাচালি করে। এরপর তা থেমে যায়।
তার আগে প্রতারণার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর সোহেল রানা ভারতে পালিয়ে যান। ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে গ্রেপ্তার হন। প্রতারণার পর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তিনি নেপথ্যে থেকে ই-অরেঞ্জ নামে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সোহেল রানার যত সম্পদ : পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর শাহজাদপুর, গুলশান মডেল টাউন ও ভাটারা এলাকায় একটি করে এবং নিকেতনে দুটি ফ্ল্যাট আছে। গুলশানে একটি বাণিজ্যিক ভবনে ৯ কোটি টাকায় স্পেস (জায়গা) কিনেছেন সোহেল রানা। ভাটারা ও পূর্বাচলে দুটি প্লট এবং গুলশান ও উত্তরায় তিনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া গেছে। নিজ জেলা গোপালগঞ্জ ও খাগড়াছড়িতে তিনি জমি কিনেছেন বলে জানা যায়।
থাইল্যান্ডের পাতায়ায় সুপারশপ, জমি ও ফ্ল্যাট; পর্তুগালের লিসবনে সুপারশপ, বার ও রেস্তোরাঁ; ফিলিপাইনের ম্যানিলায় বার এবং নেপালের কাঠমান্ডুতে একটি বার ও ক্যাসিনো আছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।
জানা যায়, সোহেল রানা ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গুলশান থানার এসআই ছিলেন। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মালিবাগে পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) কর্মরত ছিলেন। পরে পদোন্নতি পেয়ে পরিদর্শক হলেও ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) ছিলেন তিনি। এরপর চার মাস পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটে ছিলেন। ২০২০ সালের ২৮ মে বনানী থানায় পরিদর্শকের (তদন্ত) দায়িত্ব পান।