আগের সরকারের মতো কৃচ্ছ্রসাধনের পথ অনুসরণ করে ঘাটতি কমাতে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছর সংকোচমূলক বাজেট ঘোষণা করে ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। ২০২৪-২৫ বছরের তুলনায় প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ২০২৫-২৬ বছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করে অন্তর্বর্তী সরকার। যার ফলে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন উভয় খাতের বরাদ্দও কমানো হয়। এতে রাজস্ব আয় ও এডিপি বাস্তবায়ন কিছুটা বাড়লেও মূল্যস্ফীতির চাপ কমানো যায়নি। বৈদেশিক সহায়তা ও ঋণের মাত্রা কমছে। বরং বেড়েছে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহতভাবে সংকুচিত হচ্ছে। ফলে বাজেটের ভারসাম্য এখনো ঝুঁকির মুখেই রয়েছে। অর্থনীতি ও প্রশাসনের নানা সংস্কার কর্মসূচির কারণে অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আদায় কিছুটা বেড়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়নও কিছুটা বেড়েছে। যদিও বৈদেশিক সহায়তা ও ঋণ কমেছে। তবে মূল্যস্ফীতির চাপ কমিয়ে আনতে পারেনি সরকার। অক্টোবর শেষে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৮.১৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ভরা মৌসুমেও শাক-সবজি, মাছ, মাংস, চাল, ডাল, পিঁয়াজ, রসুনের দাম আকাশচুম্বী। ফলে বছর শেষে মূল্যস্ফীতির চাপ কাক্সিক্ষত হারে কমিয়ে আনা সরকারের জন্য অসম্ভবই হবে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, সামগ্রিক বাজেট পরিস্থিতি এখনো ভারসাম্যহীনতার ঝুঁকিতে রয়েছে। যদিও সেটা আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে।
জানা গেছে, গত অর্থবছরে ১ লাখ কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে। যার প্রভাব চলতি অর্থবছরেও রয়েছে। অবশ্য চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আগের বছরের তুলনায় রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব আদায় করেছে। কিন্তু সেটা টার্গেটের তুলনায় সামান্য কম। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৯০ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছে, যা এযাবৎকালের যে কোনো অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় সর্বোচ্চ রেকর্ড রাজস্ব আদায়। বিগত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা, সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ১৫ হাজার ২৭০ কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে, যার প্রবৃদ্ধি হার ২০ দশমিক ২১ শতাংশ।
কিন্তু সরকার এডিপি থেকে অনেকগুলো মেগা প্রকল্প বাদ দেওয়ায় অর্থের চাহিদা কমেছে। এতে করে নিয়মমাফিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে কিছুটা গতি পেয়েছে। এডিপি থেকে মেগা প্রকল্পগুলোকে বাদ দেওয়ায় ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রবণতাও কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থায় সরকারের মোট ঋণ কমে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকায়, যা গত জুন শেষে ছিল ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৮৬২ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে ঋণ কমেছে ৪২৭ কোটি টাকা। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছিল ৩ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টদের মতে, উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় স্থবির থাকায় ব্যাংক ঋণের ওপর সরকারের নির্ভরতা কমছে।
এদিকে ঋণনির্ভর উন্নয়নের চাপ এখন অর্থনীতিতে স্পষ্ট হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিদেশি ঋণ প্রাপ্তির চেয়ে প্রায় ১৩ কোটি ডলার বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে। ফলে নতুন ঋণ দিয়ে পুরোনো ঋণ পরিশোধের প্রবণতা বেড়েছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকেও ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে সরকারকে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বৈদেশিক ঋণছাড় হয়েছে ১১৪ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। কিন্তু এ সময়ে পরিশোধ করা হয়েছে ১২৭ কোটি ৯৯ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে পরিশোধ করা হয়েছিল ১১২ কোটি ডলার। সে তুলনায় এবারের পরিশোধ বেড়েছে ১৫ কোটি ৩৩ লাখ ডলার, যার মধ্যে শুধু আসল পরিশোধই বেড়েছে ১৩ কোটি ডলার।
চলতি বাজেটে রাজস্ব আয়ের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রার পরও কর ও জিডিপির অনুপাত ৮-৯ শতাংশের কম থাকবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। অথচ ‘ভারতের কর ও জিডিপির অনুপাত ১৮ শতাংশ। আমাদেরও সে জায়গায় যাওয়া জরুরি। এজন্য কর ব্যবস্থার অটোমেশনে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। অন্যথায় বছর শেষে আবারও বিশাল অঙ্কের রাজস্ব ঘাটতি তৈরি হবে। যা মূলত বাজেটের ভারসাম্যকে ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেবে বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।