সাম্প্রতিক সময়ে অন্যরকম ঘটনাবহুল দিন ছিল ১৩ নভেম্বর। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণে এ দিনটি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হবে। একই দিনে অনেক ঘটনার সাক্ষী হলো বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল চব্বিশের জুলাই-আগস্ট গণহত্যার প্রথম মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণা করেন বৃহস্পতিবার সকালে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় ১৭ নভেম্বর।
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণার এই দিন ধার্য করেন। ট্রাইব্যুনালে অন্য দুই সদস্য বিচারক ছিলেন মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
বহুল আলোচিত এ মামলায় পাঁচটি অভিযোগ এনে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে প্রসিকিউশন। একই দিনে আদালতপাড়ায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। সংবিধান পঞ্চদশ সংশোধনীর হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিলের অনুমতি দিয়েছেন আপিল বিভাগ।
বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এ দিন সকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলোপসহ বেশ কয়েকটি বিষয় পরিবর্তন করে আনা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে হাই কোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিলের (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) ওপর দ্বিতীয় দিনের শুনানি শুরু হয়। বেশ কিছু বিষয়ে পরিবর্তন করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়।
রাষ্ট্রপতি ২০১১ সালের ৩ জুলাই তাতে অনুমোদন দেন। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনসংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়; সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয়।
অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী করে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধানও যুক্ত করা হয়। আগে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনে নির্বাচন করার বিধান থাকলেও ওই সংশোধনীতে পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিষয়টি সংযোজন করা হয়।
বৃহস্পতিবার ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের সূচনা করে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন প্রথম ধাপে ১২টি দলের সঙ্গে সংলাপে অংশ নেয়। ধারাবাহিক সংলাপে পর্যায়ক্রমে সব দল অংশগ্রহণ করবে বলে জানা গেছে। এর মধ্য দিয়ে সংসদ নির্বাচনের পথে কমিশন আনুষ্ঠানিক যাত্রা করল। বৃহস্পতিবার কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী লকডাউন কর্মসূচি পালন করে। কর্মসূচির কদিন আগে থেকেই সারা দেশে নাশকতামূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড জনমনে ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে। বিক্ষিপ্তভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। তবে দিনের সবচেয়ে আলোচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণ। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং গণভোট নিয়ে রাজনৈতিক অনৈক্য ও বিভক্তির প্রেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টা জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন।
আপাতদৃষ্টে বৃহস্পতিবারের ঘটনাবহুল দিনের সব ঘটনা আলাদা হলেও তা পারস্পরিক সম্পর্কিত। একটি আরেকটির সঙ্গে সম্পর্কিত। এসব ঘটনা এক বিন্দুতে মেলালে আগামীর বাংলাদেশ কোন পথে এগোবে তার একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী দলগুলো যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে, তাহলে দেশ গণতন্ত্র ও শান্তির পথে এগিয়ে যাবে। আর যদি বিভক্ত হয়, তাহলে পতিত স্বৈরাচার পুনর্বাসিত হবে। দেশে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে। অগ্নিসংযোগ ও গুপ্ত হামলা জনজীবনে আতঙ্ক সৃষ্টি করবে। দেশের ভবিষ্যৎ কোন পথে যাবে, তা নির্ভর করছে প্রধান উপদেষ্টার সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে গ্রহণ করে তার ওপর।
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে সুস্পষ্টভাবে চলমান রাজনৈতিক সংকটের একটি গ্রহণযোগ্য এবং যৌক্তিক সমাধান ঘোষণা করেছেন। কারও পক্ষে বা বিপক্ষে না গিয়ে তিনি জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। একদিকে যেমন তিনি গণভোট নিয়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক বিভাজনের বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তেমন জুলাই সনদ বিষয়ে গণভোটে চারটি প্রশ্ন দিয়ে জনগণকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বধীনতা দিয়েছেন। একাধিক প্রশ্ন থাকায় সব দলের দাবির প্রতি যেমন শ্রদ্ধা রাখা হয়েছে, তেমন জনগণ কী চায় তার পথও উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে যেভাবে গণভোটের প্রশ্ন উপস্থাপন করেছেন, তা এ রকম-আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করছেন? ‘ক) নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে। খ) আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ জন সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে। গ) সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে। ঘ) জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।’
গণভোটের দিন এ চারটি বিষয়ের ওপর একটি মাত্র প্রশ্নে আপনি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে আপনার মতামত জানাবেন।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রধান উপদেষ্টা সবকিছু চাপিয়ে দেননি। বরং যে ৩০টি সংবিধান সংশোধন প্রস্তাবে সব দল একমত হয়েছে, তা বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক করেছেন। যেসব বিষয়ে ভিন্নমত রয়েছে সেগুলো রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাস্তবায়ন করবে। অর্থাৎ বিএনপি নির্বাচনে জয়ী হলে তারা আপত্তিহীন ৩০টি সংশোধনী বাস্তবায়ন করবে। বাকিগুলোর বিষয়ে তাদের অবস্থানের আলোকে সিদ্ধান্ত নেবে। একইভাবে জামায়াত বা এনসিপি জয়ী হলে ৩০টি মীমাংসিত বিষয়ে সংশোধনী আনবে, বাকিগুলোর ব্যপারে তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে। আমি মনে করি এর চেয়ে যৌক্তিক এবং গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত আর হতে পারে না।
এ রকম একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে যদি কোনো দল আপত্তি করে তাহলে বুঝতে হবে, তারা দেশে নির্বাচন চায় না। গণতন্ত্র চায় না। তারা দেশে একটা অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়। এ রকম একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে শেষ পর্যন্ত কেউ লাভবান হবে না। চব্বিশের পরাজিত শক্তি ফিরে আসবে।
তাই আমাদের প্রত্যাশা-রাজনৈতিক দলগুলো এখন হুমকিধমকির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসবে। যমুনা ঘেরাওয়ের মতো আত্মঘাতী কর্মসূচি থেকে সরে আসবে। নির্বাচনের পথে হাঁটবে সব দল। ১৩ নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ এবং প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ একটি বার্তা দিয়েছে, তা হলো-ঐক্যেই জয়, বিভক্তিতে ক্ষয়।