ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ভোটের অনুকূল পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। সেই সঙ্গে নির্বাচনি আইনে এখনো কিছু সংস্কার চায় কয়েকটি দল। দলের সব স্তরের কমিটিতে নারী প্রতিনিধিত্ব কমানোরও সুপারিশ এসেছে দুটি দলের তরফ থেকে। এ ছাড়া সংসদ নির্বাচনের জামানত কমানো, নির্বাচনি ব্যয় মনিটরিং এবং প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য সংলাপে সুপারিশ করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। এদিকে আচরণবিধি প্রতিপালনে দলগুলোর সহায়তা চেয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ইসি সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি চায় না; বরং সহায়তা প্রত্যাশা করছে। গতকাল সকালে আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সঙ্গে সংলাপে বসে ইসি। প্রথম দিনের প্রথম পর্বে ছয়টি দলের প্রতিনিধি অংশ নিয়ে ভোটের প্রাক পরিবেশ, শঙ্কা, ইসির আন্তরিকতা, আইন সংস্কার নিয়ে আলোচনা করেছে।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী বলেন, এখনো পর্যন্ত যথেষ্ট নিরাপত্তা সংকট বিরাজ করছে। গত দুই তিন দিনের ঘটনা অবশ্যই বিবেচনায় নেব। তিনি বলেন, কোনো কোনো দল কর্তৃত্ব প্রমাণে ডাকাত থেকে শুরু করে চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে হয়তো তালিকা রয়েছে। আমার মনে হয়, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে এখনো পর্যন্ত যথেষ্ট পরিমাণে যে উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল সেটা শুরু হয়নি। আমরা সঠিক সময়ে নির্বাচন চাই। তফসিল ঘোষণার পূর্বে অবশ্যই সিকিউরিটি অপারেশন করা উচিত, যাতে জনগণের আস্থা ফিরে আসে। জোটে ভোট করলে নিজ দলের প্রতীকে ভোট করার বিধান করায় ‘এতে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। আগে যেমন ছিল তেমন থাকলে সবচেয়ে ভালো হয়। প্রতীক জোটের ওপর, দলের ওপর ছেড়ে দিতে হবে আগের মতো। আরপিও সংশোধন করা ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির দাবি রেখেছেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য নিয়ামুল বশীর ও আওরঙ্গজেব বেলাল।
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউসুফ সাদেক হক্কানী বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কালো টাকা রোধ, প্রভাবমুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মহিউদ্দিন বলেন, ইসির প্রতি আস্থাহীনতা রয়েছে। আস্থা তৈরি করবে বর্তমান ইসি। ভোটের পরিবেশ সৃষ্টির আগে নির্বাচন হওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশ মুসলিম লীগের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর বলেন, সঠিক সময়ে নির্বাচন চাই। নির্বাচনি পরিবেশের যেন উন্নতি হয় সে ব্যবস্থা নিতে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
সংসদ ও স্থানীয় নির্বাচনে শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণের দাবি জানান দলটির আকবর হোসেন পাঠান। তিনি বলেন, এমপি প্রার্থী হতে ন্যূনতম মাস্টার্স এবং উপজেলা নির্বাচনে স্নাতক, ইউপি চেয়ারম্যানে এইচএসসি, মেম্বারে এসএসসি নির্ধারণ করার আবেদন থাকবে।
সংলাপে এ দুজনের বক্তব্যের পর প্রেসিডেন্ট জুবেদা কাদের চৌধুরী ভিন্ন বক্তব্য দিলেন। প্রত্যেক দল নারীদের কেন সংলাপে আনেনি সে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘আজ আমাদের এখানে ওয়ান থার্ড মহিলা আসেনি। মহিলারা ভালো শিক্ষিত। প্রত্যেক পার্টি কেন আনলেন না, তাদের সচেতন হতে হবে।
ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপির চেয়ারম্যান শেখ ছালাউদ্দিন ছালু বলেন, জামানতের টাকার পরিমাণ কমাতে হবে। নিবন্ধন দেওয়ার বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। ইসি নিবন্ধন না দিলেও আদালত থেকে নিবন্ধন নিয়ে আসছে। তাহলে ইসি কাগজপত্র ঠিকমতো দেখছে না? এ বিষয়টি কমিশনের ভালোভাবে দেখতে হবে। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের প্রতিনিধি বলেন, সবাই এসে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষ নির্বাচন করার কথা বলে। কিন্তু সব নির্বাচনই নিরপেক্ষতা হারানো হয়, এটা প্রসিদ্ধ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জামানতের ২০ হাজার টাকা পুনর্নির্ধারণ, নির্বাচন কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার নিয়োগসহ ১০ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। দলের সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করে কমিশন দেখবে বলে ইসি সচিব আখতার আহমেদ জানিয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনার মো. আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ জানান, ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত যারা ১৮ বছর বয়সি তাদের অন্তর্ভুক্তের সময়সীমা রাখা হয়েছে। এবার নির্বাচন সামনে রেখে প্রবাসে যারা অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন তাদের বিষয়ে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, ভোটার হালনাগাদ কার্যত্রম উন্মুক্ত রয়েছে। দেশের ভেতরে বাদ পড়া ভোটারদের তফসিল ঘোষণার আগেও তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, আচরণবিধি প্রতিপালনে সবার সহযোগিতা দরকার। সবাই মানলে নির্বাচনি পরিবেশ ভালো হতে বাধ্য।
নির্বাচন কমিশনার তাহমিদা আহমদ বলেছেন, ইসি ভোটে রেফারির ভূমিকায় থাকবে। দলগুলো মাঠে থাকলে, সবার সহযোগিতা পেলে রেফারিগিরি সম্ভব।
সমাপনী বক্তব্যে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন জানান, আচরণবিধি প্রতিপালনে সহায়তা করতে হবে। পাশাপাশি সবার কাছে ব্যাপক প্রচারণা দরকার। আচরণবিধি মানতে ও মানাতে সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে।
আচরণবিধি প্রচারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে দলগুলোর প্রতি সিইসি বলেন, আপনারা কেউ গোঁ ধরে বসে থেকে আরণবিধি মানবই না বলেন, তাহলে তো সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। আমরা সংঘর্ষ চাই না। কাউকে মোকাবিলা করতে চাই না; সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আচরণবিধি প্রতিপালনে এগিয়ে নিতে চাই।
এদিকে নির্বাচন সামনে রেখে আচরণবিধি প্রতিপালনে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন। ভোটের তফসিল ঘোষণার আগে সব ধরনের আগাম পোস্টার সরিয়ে ফেলার আহ্বান জানিয়ে সতর্ক করে তিনি বলেছেন, আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে ‘কোনো ছাড় দেওয়া হবে না’। এ ছাড়া নিজেদের নিরপেক্ষ রেফারির ভূমিকায় দেখতে চান মন্তব্য করে সিইসি বলেন, ‘মূল প্লেয়ারদের সহযোগিতা না পেলে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হয়ে যাবে।’ এক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা কামনা করেছেন নাসির উদ্দিন। গতকাল সকালে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের শুরুত্বে সভাপতি হিসেবে স্বাগত বক্তব্য দেন সিইসি।
জামানত কমানো, ব্যয় মনিটরিং, প্রশাসনে নিয়ন্ত্রণ আনার দাবি : নির্বাচনের জামানত কমানো, নির্বাচনি ব্যয় মনিটরিং এবং প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য বিকালের সংলাপে সুপারিশ করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। গতকাল বিকালে নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনে আয়োজিত সংলাপে অংশ নিয়ে বিভিন্ন দলের নেতারা এমন সুপারিশ করেন।
বিকালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম)-এর প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
সংলাপে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রার্থীদের ব্যয়সীমা। নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের জন্য একটি নির্ধারিত ব্যয়সীমা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু বাস্তবে এই ব্যয়সীমা কতটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব তা প্রশ্নসাপেক্ষ। ইতোমধ্যেই আমরা দেখছি, কিছু রাজনৈতিক দল কোটি কোটি টাকা খরচ করে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছে, যা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই হচ্ছে। এ সময় তিনি জামানত কমিয়ে ৫ হাজার টাকা করার দাবি তোলেন। সিপিরি সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ কাফি রতন বলেন, এক উপজেলা ভোটে অন্য উপজেলা থেকে ভোট কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া, নির্বাচনে কালো টাকার খেলা, পেশি শক্তির খেলা, ধর্মের অপব্যবহার এবং প্রশাসনিক কারসাজি বন্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দরকার সরকার, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলসমূহের সদিচ্ছা। এ ছাড়া টাকা, পেশিশক্তি, সাম্প্রদায়িকতা, আঞ্চলিকতা ও প্রশাসনিক কারসাজিমুক্ত নির্বাচনি পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং সবার ভোট দেওয়া ও প্রার্থী হওয়ার সমান অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। কিন্তু এগুলো নিয়ে আলোচনা, মতামত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনা কী হয়েছে তা এখনো আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জিএসডি) দলের সিনিয়র সভাপতি তানিয়া রব বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে আমরা যখন নির্বাচন করতে যাই, তখন প্রশাসনিক কিছু অসামঞ্জস্যতা ও জটিলতা লক্ষ্য করি। বলা হয়, নির্বাচনকালে প্রশাসন সম্পূর্ণভাবে নির্বাচন কমিশনের আওতাধীন থাকবে। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায় না। ফলস্বরূপ, নির্বাচনের দিন প্রার্থী এবং প্রার্থীর কর্মীরা প্রায়ই হয়রানির শিকার হন।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক বলেন, কোনো অযৌক্তিক চাপের কাছে আপনারা নতি স্বীকার করবেন না। দৃঢ়চিত্ত, বলিষ্ঠ ভূমিকা নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে আমরা দেখতে চাই। জামানত ৫ হাজার টাকার মধ্যে রাখা উচিত। তিনি বলেন, প্রার্থীর সর্বোচ্চ ব্যয়সীমা প্রায় দ্বিগুণ (৫০ লক্ষ টাকার বেশি) করার প্রস্তাব এসেছে। আমরা মনে করি, এটি সংসদকে ধনী, বিত্তবান, লুটেরা ও মাফিয়াগোষ্ঠীর ক্লাবে পরিণত করবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে সংলাপে অন্য নির্বাচন কমিশনার ও ইসি সচিব উপস্থিত ছিলেন।
ভোটের দিনে গণভোট : ‘আলোচনা করে’ মত জানাবে ইসি : একই দিনে সংসদ নির্বাচন ও জুলাই সনদ নিয়ে গণভোট আয়োজনের যে ঘোষণা প্রধান উপদেষ্টা দিয়েছেন, সে বিষয়ে ‘আলোচনা করে’ নিজেদের মত জানানোর কথা বলেছে নির্বাচন কমিশন। গতকাল বিকালে সংলাপের সমাপনী বক্তব্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়গুলো জানলে তখন আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করে কমিশনে বসে আলাপ-আলোচনা করে একটা মতামত দিতে পারব। এ বিষয়ে এ মুহূর্তে কোনো মতামত দেওয়া যথার্থ হবে না।
১৬ নভেম্বর আরও ১২ দলের সঙ্গে ইসির সংলাপ : আগামী ১৬ নভেম্বর রবিবার আরও ১২টি দলের সঙ্গে সংলাপে বসছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গতকাল ইসির জনসংযোগ শাখার সহকারী পরিচালক মো. আশাদুল হক এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি জানান, ১৬ নভেম্বর সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত গণফোরাম, গণফ্রন্ট, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি) ও বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি। এ ছাড়া দুপুর ২টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-বাংলাদেশ জাসদ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপ, তৃণমূল বিএনপি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। গতকাল (বৃহস্পতিবার) ১২ দলের সঙ্গে সংলাপ করেছে ইসি।