দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলেও নওগাঁর আত্রাই নদীর পানি আরও বেড়ে ৩০টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। পাশাপাশি খাগড়াছড়িতে কাপ্তাই হ্রদের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় মহালছড়িতে ৬ গ্রামের ২০০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। শরীয়তপুরেও পদ্মার ভাঙন অব্যাহত থাকার খবর পাওয়া গেছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো বিবরণ-
শরীয়তপুর : প্রমত্তা পদ্মা নদীর পাড়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকা জৈবন নেছা বলছিলেন, ‘পদ্মা নাম শুনলেই গা শিহরে ওঠে। ছেলে সন্তান নিয়ে ভালোভাবেই জীবন পার করছিলাম। আজ আমি সর্বস্বান্ত। পদ্মা গিলে খেয়েছে আমার শেষ সম্বল।’ তিনি কাঁদতে কাঁদতে যা বলছিলেন তার মর্মার্থ, তিনি আজ বাড়িঘর হারিয়ে দিশাহারা। সাজানো-গোছানো বাড়ি ছিল তার।
নদীর পাড়ে বসে কেঁদেই যাচ্ছিলেন জৈবন নেছা। তার কান্নায় আকাশবাতাস ভারী হয়ে উঠছিল। নদীর দিকে তাকিয়ে তিনি তাঁর শেষ সম্বল খোঁজার চেষ্টা করছিলেন। জৈবন নেছা জানান, তিনি প্রতিদিনই এভাবে বসে থাকছেন। এ-ও জানান, এখনো তার ভাগ্যে জোটেনি সরকারি কোনো সাহায্য।
এদিকে শরীয়তপুরে পদ্মা সেতুর কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড রক্ষায় নির্মিত তীর রক্ষা বাঁধের ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। গতকালও ভাঙন আতঙ্কে ২০টি বসতঘর সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। নদীভাঙনে দিশাহারা কয়েক শ পরিবার। গেল দুই মাসে শতাধিক বসতবাড়ি ও স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙন আতঙ্কে ৪ শতাধিক বসতবাড়ি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এদিকে নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে শুকনো খাবার, ঢেউটিন ও অর্থ সহায়তা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। বালুভর্তি জিওব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধের চেষ্টা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। জেলা প্রশাসক জানান, ভাঙনকবলিতদের সরকারিভাবে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের শরীয়তপুর জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মাদ তারেক হাসান বলেন, ‘পদ্মার প্রবল স্রোতের কারণে ভাঙন ঠেকানো কঠিন হচ্ছে। আমরা আপৎকালীন কাজ করছি। স্থায়ী প্রতিরক্ষাব্যবস্থার জন্য প্রকল্প প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে দ্রুত কাজ শুরু হবে। এ পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে ভাঙন ঠেকাতে ১ লাখ ১০ হাজার জিওব্যাগ ফেলা হয়েছে।’ জেলা প্রশাসক শরীয়তপুর তাহসিনা বেগম বলেন, ‘এলাকায় ভাঙন পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষয়ক্ষতির তালিকা তৈরি করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
নওগাঁ : নওগাঁর মান্দায় বিপৎসীমা ছুঁইছুঁই করছে আত্রাই নদীর পানি। টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে নদীর পানি বাড়তে থাকায় দুই তীরে অবস্থিত বেড়িবাঁধ ও বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের অন্তত ৩০টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ২৪ ঘণ্টায় আত্রাই নদীর পানি ১০৩ সেন্টিমিটার বেড়েছে। গতকাল বিকালে নদীর মান্দার জোতবাজার পয়েন্টে পানির উচ্চতা রেকর্ড করা হয় ১৫ মিটার। মান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আখতার জাহান সাথী বলেন, আত্রাই নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, দুর্যোগ মোকাবিলায় শুকনো খাবার মজুত ও আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুতের বিষয়েও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
রাঙামাটি : একটানা বৃষ্টি এবং উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে কাপ্তাই হ্রদের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে গত তিন দিন ধরে পানিবন্দি রয়েছেন রাঙামাটির সাতটি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ডুবে যাওয়ায় ওই সব এলাকার মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। স্থানীয় প্রশাসন বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের আশ্রয়ের জন্য ২৪৬টি আশ্রয় কেন্দ্র খুলেছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুত আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।
রাঙামাটি জেলা শহরের শান্তিনগর, রসুলপুর, ব্রাহ্মণটিলা, পৌর কলোনি, আসাম বস্তি, পাবলিক হেলথ এলাকা হ্রদের পানিতে তলিয়ে গেছে। বাঘাইছড়ি উপজেলার রূপকারী ইউনিয়ন, মাস্টারপাড়া, মধ্যমপাড়া, হাজিপাড়া, মাদারাসাপাড়া, এফ ব্লক, বটতলী, আমতলী ইউনিয়নসহ আশপাশের নিম্নাঞ্চল হ্রদের পানিতে ডুবে গেছে। লংগদু উপজেলার ঝরনা টিলা, ভাসাইন্যাদম ইউনিয়ন, বগাচত্বর ইউনিয়নের জালিয়াপাড়া, গুলশাখালী ইউনিয়নের সোনাগাঁওপাড়া, মাইনী ইউনিয়নের এফআইডিসি বড় কলোনি, বিলাইড়ি উপজেলা সদর, ধূপ্পারছড়, বহলতলী, বাঙ্গালকাটা এলাকাসহ নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল, জুড়াছড়ি উপজেলা, কাপ্তাই উপজেলা এবং নানিয়ারচর উপজেলার নিম্নাঞ্চল হ্রদের পানিতে তলিয়ে গেছে।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, রাঙামাটি সদর, নানিয়ারচর, লংগদু এবং বাঘাইছড়ি উপজেলার ২০টি ইউনিয়ন এবং রাঙামাটি ও বাঘাইছড়ি পৌরসভা মিলে মোট ৮১টি গ্রামের বাসিন্দারা পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। লংগদু এবং বাঘাইছড়ি উপজেলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে খাদ্যসহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এদিকে গতকাল তৃতীয় দিনের মতো কর্ণফুলী নদীতে স্রোত থাকায় রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনার ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। ফেরি চলাচল বন্ধ থাকায় বান্দরবান জেলা, রাঙামাটির রাজস্থলী, কাপ্তাই উপজেলা এবং চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বাসিন্দাদের মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। যে কারণে ওসব অঞ্চলের মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
খাগড়াছড়ি : খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে রাঙামাটির কাপ্তাই হৃদের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্লাবিত হয়েছে মহালছড়ি উপজেলার সিলেটিপাড়া, চট্টগ্রামপাড়া, ব্রিজপাড়া, কেয়াং ঘর এলাকার ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। পানি বাড়ায় এক সপ্তাহ ধরে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। ঘরে পানি ডুকে পরায় ভোগান্তিতে পড়েছেন স্থানীয়রা। মহালছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবু রায়হান জানান, কাপ্তাই লেকের পানি না কমায় সদর ও মুবাছড়ি ইউনিয়নের ব্রিজপাড়া, কাপ্তাইপাড়া, সিলেটিপাড়া, চট্টগ্রামপাড়ার প্রায় ২০০ পরিবার পানিতে ডুবে গেছে। পানিবন্দি ২০০ পরিবারকে খাদ্যসহায়তা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মহালছড়ি দাখিল মাদরাসা আশ্রয় কেন্দ্রে ১২টি পরিবারে ৩৪ জন আশ্রয় নিয়েছে। তাদের উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রান্না করা খাবার দেওয়া হচ্ছে।