রাষ্ট্র কেবল একটি বাহ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়। যা আইন, বিচার ও বিভিন্ন বাহিনীর ওপর নির্ভর করে চলে। রাষ্ট্রের প্রকৃত রূপ নির্ধারিত হয় মানুষের চেতনা, নৈতিকতা ও পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে। রাষ্ট্র আমাদের সম্মিলিত মনোভাবের প্রতিবিম্ব। ব্যক্তি যদি অন্তরে পরিশুদ্ধ হয়, রাষ্ট্র এমনিতেই সুন্দর হয়ে যাবে। রাষ্ট্র কেবল নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ করার কাঠামো নয়। এতে রাষ্ট্রের সম্ভাবনা ও গুরুত্ব খর্ব হয়। বরং প্রজ্ঞাসম্পন্ন চিন্তাভাবনার সামষ্টিক রূপ হয়ে উঠতে পারে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র কেবল সামাজিক চুক্তি নয়, এটি সত্তার জাগরণ। সামাজিকতার সর্বোচ্চ বিকাশ রাষ্ট্রেই সম্ভব। যেখানে সম্পর্ক প্রাণবন্ত থাকে সেখানে রাষ্ট্র টিকে থাকে। যেখানে সম্পর্ক মরে যায় সেখানে রাষ্ট্রও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। রাষ্ট্র কেবল কিছু কল বা প্রযুক্তি বা সমীকরণ দিয়ে চলে না। এটি চলে করুণা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে।
রাষ্ট্র যদি কেবল নিয়ম, আদেশ বা বাহ্যিক আইন হয়; তবে তা জীবন্ত নয়; এক ধরনের জড়ো মূর্তি মাত্র। রাষ্ট্রকে হতে হয় চৈতন্যের বহিঃপ্রকাশ। রাষ্ট্র গড়ে ওঠে ভিতরের আলো ও অন্ধকারের সংঘাতে। রাষ্ট্র এক জীবন্ত দেহ, যার হৃদয় হলো প্রজ্ঞা। আলোচনা, সহযোগিতা ও সমাজ গঠনই রাষ্ট্রের আসল কাজ। রাষ্ট্র ও ব্যক্তির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। রাষ্ট্র ও ব্যক্তিকে একে অপরের আয়না বলাটাও দূষণীয় নয়। এখানে ব্যক্তি নিজেকে বুঝে ওঠার সুযোগ পায় এবং সেই বোধ থেকে সমাজে দায়িত্বশীল হয়ে ওঠে। ব্যক্তি যদি আত্মিকভাবে দুর্বল ও পশ্চাৎপদ হয়, রাষ্ট্র হয়ে উঠবে উ™£ান্ত ও দমনমূলক। আমরা জনগোষ্ঠীর জায়গা থেকেও জিনিসটা বলতে পারি। রাষ্ট্র এমন এক আয়না যেখানে একটি জনগোষ্ঠীর অন্তর্জগৎ প্রতিফলিত হয়। যদি জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনা কলুষিত হয় তবে রাষ্ট্র কলুষিত হবে। যদি জনগোষ্ঠীর অন্তর মুক্ত হয় তবে রাষ্ট্র উদার হবে। তাই রাষ্ট্র এক প্রতিচ্ছবি। জনগোষ্ঠী ব্যক্তি থেকে ভিন্ন নয়। তাই ব্যক্তির বিকাশ বাদ দিয়ে বিমূর্তভাবে জনগোষ্ঠীর বিকাশ অসম্ভব। বিকাশের পরিকল্পনা করতে হবে জনগোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে কিন্তু বাস্তবায়ন করতে হবে ব্যক্তির কথা মাথায় রেখে। যাই হোক রাষ্ট্রকে পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন ব্যক্তির আত্মজ্ঞান। রাষ্ট্রকে ধরা যেতে পারে, ‘ব্যক্তির সম্প্রসারিত অবয়ব’ হিসেবে। অর্থাৎ প্রত্যেক নাগরিকের চিন্তাচেতনা মিলিত হয়ে গঠন করে এক রাষ্ট্রসত্তা। রাষ্ট্র যেন এক দিগন্ত যেখানে সরলভাবে ব্যক্তি, সমাজ, সংসার, প্রজ্ঞা ও করুণা মিশে যেতে পারে। রাষ্ট্র যদি ধর্মহীন হয়, তবে তা আত্মাশূন্য। পক্ষান্তরে রাষ্ট্র যদি নির্দিষ্ট ধর্মমতে (রিলিজিয়ন) চলে, তবে তা আত্মঘাতী। ধর্ম বলতে বোঝা উচিত সত্য ও সনাতন (চিরন্তন) মার্গ, যা সব মত ও পথের ঊর্ধ্বে। এ মার্গ সত্তার বোধ ও করুণা ভাবকে জাগ্রত করে। রাষ্ট্রকে এই প্রকৃত ধর্মকে ধারণ করতে হবে, যা সব মত ও পথের ঊর্ধ্বে। না কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মমত, না কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ধর্মহীন হওয়া-এটাই রাষ্ট্রের অগ্রগতির পথ। রাষ্ট্রের প্রয়োজন অন্তর্জাগরণ ও ন্যায্যতা।
রাষ্ট্র কেবল নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বা প্রশাসনিক অঞ্চল নয়-তা হলো মৃন্ময়ী মূর্তির অন্তরালে চিন্ময়ীর প্রকাশ। রাষ্ট্রে থাকতে হবে আত্মজিজ্ঞাসা, দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের স্পৃহা ও নৈতিকতার পূর্ণাঙ্গ অনুশীলন। মানুষের অন্তরাত্মাকে জাগানো, সমাজে ন্যায়, সহানুভূতি ও মৈত্রীর বিস্তার এবং প্রজ্ঞা ও সাধনার পরিবেশ সৃষ্টি করা-এগুলো ছাড়া রাষ্ট্রের আলাদা কোনো কাজ নেই।
রাষ্ট্র যদি প্রজ্ঞাহীন হয় তবে তা দানব হয়ে ওঠে। এই সংকট সমাধান করতে হলে রাষ্ট্রকে শিক্ষানির্ভর চৈতন্যসমাজ। শিক্ষা মানে শুধু পঠন-পাঠন বা কাগজ সংগ্রহ করা নয় বরং নৈতিক বিকাশ, জগৎকে উপলব্ধির চর্চা এবং অন্তর্জাগরণ। শিক্ষায় থাকবে আত্মজ্ঞানের পথনির্দেশ, সমাজচেতনার বীজ, ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা এবং প্রকৃতির সঙ্গে সখ্য। রাষ্ট্র তখনই প্রকৃত শিক্ষা দিতে পারে যখন তা নিজেই এক শিক্ষাপ্রাপ্ত সত্তা হয়ে ওঠে।
রাষ্ট্রের কাঠামোকে কোনো কেন্দ্রীভূত শক্তিবলয় হিসেবে গড়ে তোলা যাবে না। রাষ্ট্রকে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দিলে চলবে না; ছড়িয়ে দিতে হবে সর্বত্র। প্রতিটি নাগরিক, প্রতিটি অঞ্চল ও প্রতিটি সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী যেন রাষ্ট্রের অধিষ্ঠিত হয়। সর্বত্র রাষ্ট্রের শক্তি আবর্তিত হতে হবে। রাষ্ট্রের হৃৎস্পন্দন হবে আলোকিত ভাবনা বা মননশীলতা। রাষ্ট্রকাঠামোকে এমনভাবে সাজাতে হবে যেন কেন্দ্রে ও প্রান্তে থাকে সহযোগিতার মনোভাব ও সমন্বয়।
রাষ্ট্রের কাজ কেবল মানুষকে নিয়ে নয়। প্রাণিকুল, গাছপালা, নদী, পর্বত, সমুদ্র-এসব কিছুর প্রতি দায়িত্বশীলতা বজায় রাখাও রাষ্ট্রের কাজ। রাষ্ট্র প্রকৃতি থেকে আলাদা নয়। কিন্তু রাষ্ট্রের ভিত যদি প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কহীন হয়, তবে রাষ্ট্র নিজেই নিজের ধ্বংসের পথ তৈরি করে রাখবে। তাই পরিবেশ রক্ষা, জীববৈচিত্র্যের সুরক্ষা এবং প্রকৃতির সঙ্গে সজীব সম্পর্ক-এসব কিছুই রাষ্ট্রচালনার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
আগামী দিনে রাষ্ট্রের মাধ্যমে শুধু একটি নতুন শাসনব্যবস্থা তৈরি হবে এমন নয়; ঘটবে উন্নত, শান্তিপূর্ণ ও মানবিক যুগের সূচনা। রাষ্ট্র মানেই শাসনব্যবস্থা- এমন ধারণা আমাদের মনে গেঁথে গেছে। রাষ্ট্রকে কেবল একটি প্রশাসনিক কাঠামো, একটি সাংবিধানিক যন্ত্র অথবা ক্ষমতাবান প্রভু হিসেবে দেখা হয়েছে। কিন্তু এই ধারণা বদলাতে হবে। রাষ্ট্রের মধ্যে এক নতুন সভ্যতার সম্ভাবনা বা বীজ নিহিত। রাষ্ট্রচিন্তা কেবল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর দর্শন নয়; বরং এক জ্যোতির্ময় ভবিষ্যতের দিশা। রাষ্ট্র হবে সভ্যতার এক সাধনক্ষেত্র। সেখানে প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, অর্থনীতি- সব থাকবে; কিন্তু নিয়ন্ত্রিত হবে নৈতিকতা ও বোধের মাধ্যমে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক