রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, "আজকাল বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অসহিষ্ণুতা, উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ, মৌলবাদের মতো নেতিবাচক কর্মকাণ্ড জাতি গভীর উদ্বেগের সাথে প্রত্যক্ষ করছে। আমি মনে করি, এর উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে মুক্ত চিন্তা ও সংস্কৃতির অভাবে।" আজ শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) স্টেডিয়ামে দশম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন রাষ্ট্রপতি। '
তিনি বলেন, "জাতির অমিত শক্তি যুব সমাজ। যুব সমাজের শক্তি ও সম্ভাবনাকে দেশ গঠনের কাজে লাগাতে আমাদের যুব সমাজকে অবশ্যই অপশক্তির প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীন চিন্তার অধিকারী হতে হবে। মানবিক ও উদার হতে হবে। তাহলেই আমরা লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনকতার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারবো। এর সুফল জাতির কাছে পৌঁছাতে পারবো। এজন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী, গবেষক, অভিভাবক, ছাত্র সংগঠনসহ সকলকে সম্মিলতভাবে অবদান রাখতে হবে।"
এসময় রাষ্ট্রপতি বলেন, "কারিক্যুলামভিত্তিক শিক্ষার পাশাপাশি মুক্তচিন্তা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা, জাতিগঠনমূলক কর্মকাণ্ড, সমকালীন ভাবনা, সাংস্কৃতিক চর্চা, খেলাধুলা ইত্যাদি সৃজনশীল কর্মকাণ্ড শিক্ষার্থীদের কেবল দক্ষ ও পরিপূর্ণ করো না, বরং তাদের বুদ্ধিবিত্তিক চেতনাকেও পরিপুষ্ট করে। এর প্রভাব ব্যক্তি জীবনেতো বটেই, সামষ্টিক জীবনকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে।"
তিনি আরও বলেন, "উচ্চশিক্ষা যাতে সার্টিফিকেট সর্বস্ব না হয় কিংবা শিক্ষা যাতে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত না হয় তা দেশ ও জাতির স্বার্থে সম্মিলিতভাবে নিশ্চিত করতে হবে। এটা করতে না পারলে দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়বে এবং বিশ্ব প্রতিযোগিতায় আমরা পিছিয়ে পড়বো। যুগের চাহিদাকে ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান ও গবেষণা কার্যক্রম আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্য আমি সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানাই।"
রাষ্ট্রপতি বলেন, "গণতন্ত্রের ভিতকে মজবুত করতে হলে দেশে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। আর সেই নেতৃত্ব তৈরি হবে ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমেই। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থের কোন স্থান থাকবে না। ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্ব থাকবে ছাত্রদের হাতে। লেজুড়বৃত্তি বা পরনির্ভরতার কোন জায়গা থাকবে না। ছাত্রসমাজকেই এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। মনে রাখতে হবে সমাবর্তন শিক্ষার সমাপ্তি ঘোষণা করছে না, বরং উচ্চতর জ্ঞানভান্ডারে প্রবেশের দ্বার উন্মোচন করছে। তোমরা কেউ কেউ সে বিশাল জ্ঞানরাজ্যে অবগাহন করে বিশ্বকে আরো সমৃদ্ধ করবে।’
সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও একুশে পদকপ্রাপ্ত এমিরেটাস অধ্যাপক আলমগীর মো. সিরাজুদ্দীন। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী তাদের গবেষণার ও সৃজনশীলতার মধ্যদিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান উন্নত করেছেন। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আজকের বক্তব্যের বিষয় নির্ধারন করেছি ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক স্বাধীনতা, স্বায়ত্ত্বশাসন ও জবাবদিহিতা।’
সমাবর্তনের বিশেষ অতিথি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘আপনারা এদেশের বড় সম্পদ। এ দেশের শ্রেষ্ট মেধাবীদের একাংশ। আপনাদের আগামী দিনের কার্যক্রামের ওপর নির্ভর করছে আমাদের দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধি। আপনাদের অর্জিত শিক্ষা ও জ্ঞান বাস্তব কর্মজীবনে প্রয়োগ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করার সুযোগ আপনারা পেয়েছেন। জ্ঞান ও মেধা প্রয়োগে সৃজনশীলতা ও উদ্যোগ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা অর্জনের সীমা বা শেষ নেই। আমাদের দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন, জাতির উন্নতির জন্য আপনারা সততা নিষ্ঠার মাধ্যমে আপনাদের অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগাবেন এটাই আজকের দিনে আপনাদের কাছে প্রত্যাশা।’
এর আগে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারযোগে রাষ্ট্রপতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব আব্দুল লতিফ হলের মাঠে পৌঁছান। নেমেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে গিয়ে বিশ্রাম নেন। এরপর তিনি গাড়িযোগে সমাবর্তনস্থল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেডিয়ামে পৌঁছান। সমাবর্তন অনুষ্ঠান শুরুর পূর্বে দেশরত্ন শেখ হাসিনা এবং শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামানের নামে দুইটি বহুতল আবাসিক হলের ফলক উন্মোচন করেন তিনি।
সমাবর্তনে বাংলা সাহিত্যে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সমাবর্তনে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক ও দেশবরেণ্য সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনকে সম্মানসূচক ডক্টর অব লিটারেচার (ডি. লিট) ডিগ্রি তুলে দেন রাষ্ট্রপতি।
এদিকে সমাবর্তনে অংশ নিতে গতকাল শুক্রবার রাতের মধ্যেই ক্যাম্পাসে পৌঁছান সকল নিবন্ধিত গ্রাজুয়েট। সাবেক শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে। শুক্রবার বিকেল থেকেই ক্যাম্পসের সর্বত্র যেনো গ্রাজুয়েটদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। পুরনো বন্ধুদের পেয়ে সবাই যেনো আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ছেন। ক্যাম্পাস মাতিয়ে তোলার দিনগুলোতে ফিরে যান সবাই। পুরনো বন্ধুদরে সাথে আবার একসাথে বসে গল্প করার সুযোগ পেয়েছেন সবাই। সাবেকদের এমন গর্বিত পদচারণায় যেনো উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে পুরা ক্যাম্পাস জুড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখা যায়, স্টেডিয়াম, প্যারিস রোড, শহিদ মিনার, সাবাস বাংলাদেশ ভাস্কর্য, সকল বিভাগ, সকল আবাসিক হলের সামনে গ্রাজুয়েটরা ছবি তুলতে ব্যস্ত। কখনো সবাই মিলে ছবি তুলছেন আবার কখনো একা। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব জায়গায় পদচারণা ছিলো তার কোনো স্থানই যেনো বাদ দিতে চান না গ্রাজুয়েটরা। কয়েক বছর পর ক্যাম্পাসে ফিরে যেনো পরম মমতায় আলিঙ্গন করছেন ক্যাম্পসকে। অনেকেই আবার এক সময় যে রুমটাতে কয়েক বছর ছিলেন সেখানে গিয়ে একটু দেখা করে আসেন। এ যেনো বহু বছর পর আপন নীড়ে ফেরা। যে ক্যাম্পাস আজ তাদের গ্রাজুয়েট করে তুলেছে, দিয়েছে নতুন জীবন সেই ক্যাম্পাসে সবাই ফিরতে পেরে যেনো আনন্দের জোয়ারে ভাসছেন।
সমাবর্তনে অংশ নিতে আসা গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী লাকমিনা জেসমিন সোমা বলেন, ‘সমাবর্তনে অংশগ্রহনের স্বপ্ন সব গ্রাজুয়েটদেরই থাকে। সে স্বপ্ন আজ পূরণ হতে যাচ্ছে। খুবই ভালো লাগতেছে। এতো ভালো লাগতেছে যে ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা। সব পুরনো বন্ধুদের আবার ফিরে পেয়েছি। গল্প করছি, ছবি তুলছি। সব মিলে একটি স্বপ্নের অধ্যায় পার করছি।’
এবারের সমাবর্তনে অংশ নিতে মোট ৬ হাজার ১৪ জন গ্রাজুয়েট নিবন্ধন করেছেন। এতে ২০১১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে স্নাতকোত্তর, এমফিল, পিএইচডি, এমবিবিএস, বিডিএস ডিগ্রি অর্জনকারীদের নিবন্ধনের সুযোগ দেওয়া হয়। এতে কলা অনুষদের ১১টি বিভাগের ১ হাজার ১৪০, আইন অনুষদের আইন বিভাগের ২২৫, বিজ্ঞান অনুষদের ৮টি বিষয়ে ৯১৬, বিজনেস স্টাডিস অনুষদের ৪টি বিভাগে ৯৫৩, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ১০টি বিভাগে ১ হাজার ৩৬, জীব ও ভূ-বিজ্ঞান অনুষদের ৬টি বিভাগে ৫৬১, কৃষি অনুষদের ৪টি বিভাগের ৭২, একই অনুষদের ডিভিএম ডিগ্রির জন্য ৪৫, প্রকৌশল অনুষদের ৫টি বিভাগে ৩০১, চারুকলা অনুষদের ৬৭, এবং ইনস্টিটিউটসমূহ থেকে ১৯জন গ্রাজুয়েট স্নাতকোত্তর, এমফিল ও পিএইসডি ডিগ্রির জন্য নিবন্ধন করেন। এছাড়াও এমবিবিএস ৫৩৪ ও বিডিএস ১৪৫ জন নিবন্ধন করেছেন।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ সিফাত তাফসীর