ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলা শুরু হয়েছিলো একশো’ বছরে আগে, ১৯২১ সালে। দীর্ঘ এই পথপরিক্রমায় ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি, নানান আন্দোলনের সংগ্রামের পর একটি স্বাধীন দেশ-বাংলাদেশ, তারপর সেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কোথায় ছিলো না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়? আর এতসব যাদের হাত ধরে হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের আবেগও তাই একটু বেশি। যেমন বোঝা গেলো শনিবারের ‘শতবর্ষের মিলনমেলা’য়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে মিলিত হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। এতদিন পর পুরনো বন্ধুদের পেয়ে আনন্দ উদ্ভাসিত হয়েছিলেন তারা। সেলফি তোলা, আড্ডা দেওয়া, হৈ-হুল্লোড়, সব মিলিয়ে বিশেষ এই দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে কমতি রাখেননি কেউই।
‘বাংলাদেশের পথযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই’ এই স্লোগানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে সকাল ১০টায় শুরু হয় ‘শতবর্ষের মিলনমেলা’র আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। জাতীয় সংগীত পরিবেশন ও পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দিনব্যাপী আয়োজনের সূচনা হয়। উদ্বোধন ঘোষণা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণতম শিক্ষার্থী মো: মতিউল ইসলাম ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ। এরপর পরিবেশিত হয় শত শিল্পীর লাইভ অর্কেস্ট্রা, সংগীত এবং নৃত্য।
পরে অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের সভাপতি একে আজাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় উদ্বোধনী পর্ব। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীনতম শিক্ষার্থী ও বাংলাদেশের প্রথম অর্থ সচিব মো. মতিউল আলম। এতে বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মাদ সামাদ, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল, শতবর্ষ উদযাপন কমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি রকীবউদ্দীন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক রঞ্জন কর্মকার। অনুষ্ঠানের শুরুতে ধর্মগ্রন্থ সমূহ থেকে পাঠ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের প্রয়াত সদস্যদের স্মরণে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশে থাকাকালীন সময়ে এ দেশের প্রতি তার অবদান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে জড়িত স্মৃতিচারণ করে মো. মতিউল ইসলাম বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে স্বাধীনতার মাসে আয়োজিত এই বছরের অনুষ্ঠানের একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে। আমি মনে করি যে দেশকে আমি যা দিয়েছি, তার চাইতে দেশ আমাকে অনেক বেশী দিয়েছে। এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করে জীবনের সবচেয়ে বড় সম্মানবোধ করছেন বলেও জানান তিনি।
সভাপতির বক্তব্যে অ্যালামনাই সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, শতবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে পৌঁছানোর কথা ছিল সেখানে আসতে পারেনি। আমরা দেখেছি বিশ্বের ১০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়র ১০০ র্যাংকিংয়ের ভেতরে আনতে আমাদের সংগঠন কাজ করছে। আপনারা দেখবেন ৬০ এর দশকের পাঠাগার, মেডিকেল সেন্টার কিন্তু এখনো আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বাড়লেও সেগুলোর ধারণক্ষমতার ও সক্ষমতা বাড়েনি। তাছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী অর্থাভাবে যথাযথভাবে তাদের শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারে না। ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন তাদের জন্য কাজ করবে।
পরে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী’র সভাপতিত্বে ‘বাংলাদেশের পথযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই’ শীর্ষক একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এসময় আরও বক্তব্য রাখেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি এবং খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুক্তিযোদ্ধা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, লেখক ইনাম আহমদ চৌধুরী, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. হামিদা আক্তার বেগম, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির, সাবেক সংসদ সদস্য শামসুজ্জামান দুদু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. মো. রহমত উল্লাহ।
এসময় ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন নয়; বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত উৎকর্ষ যাতে হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। অর্থাৎ গবেষণা, প্রকাশনা ও অনুবাদ এই তিনটি কাজকে উৎসাহিত করতে হবে। তবে খুব বেশি করে দরকার হচ্ছে অনুবাদ। এছাড়াও মেধাবানরা যাতে দেশে মেধার বিকাশ ঘটানোর পরিবেশ যাতে তৈরি হয় সে কাজে মনোযোগী হওয়া এলামনাই এসোসিয়েশনের একটা বড় কর্তব্য হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি নয় বছর ডাকসুর কোষাধ্যক্ষ ছিলাম এবং সেই নয় বছর দেশে সামরিক শাসন ছিল। তখনও কিন্তু ছাত্র সংসদ ছিল। তারপর যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এলো তখন থেকে আশ্চর্যের বিষয় ছাত্র সংসদ এর নির্বাচন থেমে গেল। ছাত্র সংসদের নির্বাচন ছিল উৎসব। সেখান থেকে মেধাবীরা বেড়িয়ে আসতো। মেধাহীন ছাত্ররা কখনো নির্বাচিত হতে পারতো না।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স একশো বছর পূর্ণ হওয়ার জন্য অন্যন্য নয়। নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে, বিজ্ঞানের সমৃদ্ধিতে এবং ভাষাসহ নানা দিকে বিশেষ ভূমিকার রাখার জন্য এটি অন্যন্য বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় আগামী একশো বছর কোন পথে হাঁটবে ? সেটি এখন নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে একশত’জন গুণিজনকে মরণোত্তর সম্মাননা দেওয়া হয়। বিকেলে পরিবেশিত হয় সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান। একক সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন।
ব্যবস্থাপনা ও উপহার নিয়ে অসন্তোষ
এদিকে, দীর্ঘদিন পর বন্ধুর পেয়ে আগত প্রাক্তনীরা আনন্দ প্রকাশ করলেও অনুষ্ঠানের সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেকেই মনক্ষুণ্ণ হয়েছেন। শতবর্ষের মিলনমেলা’র মত স্মরণীয় অনুষ্ঠানে দেওয়া ‘উপহার সামগ্রী’ ও খাবার নিয়ে অনেকেই হতাশা প্রকাশ করেছেন।
অনুষ্ঠানে আগত একাধিক অ্যালামনাই বলেন, অনুষ্ঠানের মাঠে ধুলোবালি উড়ছে। এটি কার্পেট দিয়ে ঢেকে দেওয়া যেত। সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবার ছিলো খুবই সাধারণ মানের। যে সব অ্যালামনাই তাদের স্বামী বা স্ত্রী নিয়ে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন, তাদের জন্য ন্যূনতম একটি উপহারের ব্যবস্থা করা যেতো। কেননা, তারাও নিবন্ধন করেছেন। জীবন সদস্যদের দেওয়া হয়েছে পাটের ব্যাগ, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একটা প্রকাশনা, পরিচয়পত্র, মাস্ক ও স্যানিটাইজারের বোতল। এর মধ্যে শতবর্ষের স্মারক উপহারটি ছাড়া বাকিগুলো মানহীন।
আরেকজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী বলেন, শতবর্ষের অনুষ্ঠান হিসেবে আরেকটু জাকজমক হবে বলে আমরা আশা করেছিলাম। এদিকে, খাবারের প্যান্ডেলে পর্যাপ্ত ফ্যান থাকলেও মঞ্চের সামনে দর্শকসারিতে যথেষ্ট ফ্যান ছিলো না। অনেকটা সময় বসার চেয়ারগুলো ফাকা পড়ে থাকতে দেখা যায়।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল