হঠাৎ করেই যেন অশান্তির দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে সিলেটে। বাড়ছে হানাহানি, ঝরছে মানুষের রক্ত, ঘটছে খুনের ঘটনা।
গত এক মাসে সিলেটজুড়ে খুনের ঘটনা ঘটেছে ১০টি। হঠাৎ করে এই অস্থির সময়ের মধ্যে থাকা সিলেটে খুনোখুনি বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন মানুষ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা, সামাজিক অবক্ষয় প্রভৃতি কারণেই বাড়ছে অপরাধ।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেট শাখার সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, 'একের পর এক খুনাখুনির পেছনে সামাজিক অবক্ষয় একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। তবে এটাকে আমি দ্বিতীয় পর্যায়ে রাখতে চাই। প্রথম পর্যায়ে এসব ঘটনার পেছনে দায়ী হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি। একেকটি অপরাধের ঘটনায় সঠিকভাবে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয় না, সাক্ষীদের হাজির করা হয় না।'
তিনি আরও বলেন, ‘মূলত বিচারের যে দীর্ঘসূত্রিতা, এর ফলে প্রকৃত অপরাধীর সাজা হচ্ছে না। এতে অন্য কেউ অপরাধে জড়াতে ভয় করছে না।'
এক্ষেত্রে শিশু রাজন হত্যার উদাহরণ টেনে আনেন ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘শিশু রাজন হত্যায় নিম্ন আদালতে আমরা সঠিক রায় পেয়েছি। কিন্তু সে রায় এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।’
পরিসংখ্যান বলছে, গত ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময়ে সিলেট জেলায় ১০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার সাকরপুর গ্রামের সাবুল নম (২৪) নামের এক তরুণ খুন হন। পরদিন সকালে উপজেলার আলীরগাঁও ইউনিয়নের কোটাপাড়া নামক স্থান থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। পরদিন, ২৪ ফেব্রুয়ারি সিলেট নগরীর হাউজিং এস্টেট এলাকায় শাহেদ আহমদ (১৬) নামের এক স্কুলছাত্রকে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়।
গত ১২ মার্চ নগরীর মদিনা মার্কেট এলাকায় ছুরিকাঘাতে খুন সাব্বির আহমদ (২২) নামের এক যুবক। পরদিন, ১৩ মার্চ কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার দরাকুল এলাকায় বদরুল আমিন (২০) নামের এক তরুণকে গলা কেটে খুন করা হয়।
ওসমানীনগর উপজেলার মান্দারুকা গ্রামের মোস্তাফিজুর রহমান মছু (১৫) নামের কিশোরকে খুন করা হয় ১৫ মার্চ। এরপর ১৮ মার্চ খুন হন ওসমানীনগর উপজেলা পূর্ব তাজপুর গ্রামে এক প্রবাসীর বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক আনিছ উল্লাহ আনিক (৫০)।
গত ২৩ মার্চ জকিগঞ্জ উপজেলার সুলতানপুর ইউনিয়নের গণিপুর গ্রামে জমির বিরোধে দুই পক্ষের মারামারি থামাতে গিয়ে খুন হন ওসমানীনগর উপজেলার গোয়ালাবাজারের আবু বক্কর (২৫)। তিনি শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। একইদিন গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীপাশা ইউনিয়নের পূর্ব নিমাদল গ্রামে একটি পুকুর থেকে আব্দুস শহীদ (৫০) নামের এক বৃদ্ধের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়।
গত ৩১ মার্চ সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার দেওয়ানবাজার ইউনিয়নের চাম্পারকান্দি গ্রামে ‘ডাকাতদের’ গুলিতে প্রাণ হারান ইউনিয়ন ছাত্রলীগ নেতা শাহাব উদ্দিন। একইদিন নগরীর দক্ষিণ সুরমার তেলিরাই এলাকা থেকে মদন মোহন কলেজের শিক্ষক সাইফুর রহমানের (২৯) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি গোয়াইনঘাট উপজেলার ফলতইল সগাম গ্রামের ইউসুফ আলীর ছেলে।
তথ্যানুসারে, সিলেট মহানগর পুলিশের আওতাধীন এলাকায় দুটি এবং সিলেট জেলা পুলিশের আওতাধীন এলাকায় আটটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব খুনের ঘটনাকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে মনে করছে না পুলিশ।
জানতে চাইলে সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহবুবুল আলম বলেন, ‘পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে আমরা মনে করছি না। কারণ যে খুনগুলো হচ্ছে, সেগুলো মূলত ব্যক্তিগত কারণেই ঘটছে কিংবা ডাকাতি করতে গিয়ে খুনের ঘটনা ঘটেছে। আমরা পরিস্থিতিকে তখনই উদ্বেগজনক বলি, যখন দেখি যে পরিকল্পিতভাবে কোনো গোষ্ঠী কাউকে খুন করে যাচ্ছে। তবে হ্যাঁ, যে কোনো খুনই অপ্রত্যাশিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘এসব খুনের পেছনে সামাজিক অবক্ষয়, সামাজিক অস্থিরতা একটি বড় কারণ।’
এই পুলিশ কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ‘পুলিশ সতর্ক রয়েছে। অপরাধীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। আমাদের সকল থানাকে সব ধরনের অপরাধের বিষয়ে সজাগ থাকতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’
বিডি প্রতিদিন/০৪ এপ্রিল ২০১৯/আরাফাত