পিছিয়ে পড়া গ্রামীণ জনপদে শিক্ষা বিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে, একঝাঁক স্বপ্নচারী তরুণের ‘বাতিঘর’। মূলত শিক্ষা নিয়ে কাজ শুরু করলেও সংগঠনটির ব্যানারে ইতিমধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন তারা। তাদের শুভ্র চিন্তা, মেধা-মনন কাজে লাগিয়ে স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ‘বাতিঘর’কে দাঁড় করিয়েছেন তরুণদের ‘আইডল’র জায়গায়। শত তরুণের এই ‘বাতিঘর’ এখন বৃহত্তর সিলেটের অতি পরিচিত নাম।
বাতিঘরের আত্মপ্রকাশ ২০১১ সালে। সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ১২ জন তরুণ বাতিঘরের স্বপ্ন দেখেন। ‘সময়ের শৈল্পিক প্রজ্জলন’ মূলমন্ত্র ধারণ করে শুরু হয় অগ্রযাত্রা। প্রথমেই স্থানীয় রাজাগঞ্জ বাজারে সংগঠনের কার্যালয় থেকে শিক্ষার মান উন্নয়নে নেয়া হয় নানা কর্মসূচি। এলাকার বেশ কিছু প্রাইমারি স্কুল পরিদর্শন করেন তারা। ঝড়েপড়া রোধ ও ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ ঘটাতে চালু করা হয় ‘বাতিঘর শিক্ষাবৃত্তি’। এরপর সংগঠনের কার্যালয়েই ধীরে ধীরে গড়ে তোলা হয় ‘বাতিঘর পাঠাগার’। পাঠাগারকে কেন্দ্র করে স্থানীয় শিক্ষিত সমাজে ছড়িয়ে দেয়া হয় মননশীলতার চর্চা। খ্যাতনামা কবি-সাহিত্যিকদের জন্ম-মৃত্যু দিবসে আলোচনা, সাহিত্য আড্ডা, পাঠচক্র ইত্যাদি অনুষ্ঠানে প্রাণবন্ত হয়ে উঠে পাঠাগার। বিভিন্ন সময়ে পাঠাগার পরির্দশন করেন দেশ বরেণ্য শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। এসব কর্মকাণ্ডে ধীরে ধীরে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে বাতিঘর। বাড়তে থাকে বাতিঘর’র সদস্য সংখ্যা ও শুভাকাঙ্ক্ষি।
এক পর্যায়ে এলাকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কথা চিন্তা করে চালু করা হয় ‘বাতিঘর পাঠশালা’। অভিবাবকহীন স্কুল পড়ুয়া শিশু কিংবা পারিবারিকভাবে যার নেওয়া হয় না লেখাপড়ায় পরিচর্যা, সেই সব শিশুদের দায়িত্ব নেয় ‘বাতিঘর’। বিনা খরচে কোমলমতি শিশুদের পাঠ দেন বাতিঘরের দায়িত্বশীলরা। পাঠ শিখার পাশাপাশি সেখানে মেধার বিকাশে শিশুদের জন্যে রাখা হয় শিক্ষামূলক বিনোদন। পাঠাগারের শিশু কর্নার শিক্ষার্থীদের থেকে দেয়া হয় শিশুতোষ বিভিন্ন ধরণের ছবি ও গল্পের বই পড়ার সুযোগ। এখন গল্পের বইয়ের মাধ্যমে খেলাচ্ছলে ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা পড়া ও অনুধাবনের যোগ্যতা অর্জন করছে প্রতিদিন।
পরে বাতিঘর অনুভব করে প্রবাসী অধ্যষুতি বিশ্বনাথের তরুণদের অতিরিক্ত বিদেশমূখী প্রবণতা উচ্চ শিক্ষার প্রধান অন্তরায়। শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষায় আগ্রহী করে তুলতে ‘বাতিঘর’ এক পর্যায়ে হাতে নেয় ‘ক্যারিয়ার কাউন্সিলিং’ কর্মসূচি। এ কর্মসূচির অধীনে বিভিন্ন সেমিনার-কর্মশালা, ক্যারিয়ার আড্ডা ইত্যাদির মাধ্যমে ইতিমধ্যেই বিশ্বনাথের প্রায় ৩ হাজার শিক্ষার্থীকে উচ্চ শিক্ষার বিষয়ে সু-স্পষ্ট দিক নির্দেশনা দেয়া হয়।
এভাবে বিভিন্ন প্রয়োজনে জন্ম নেয় বাতিঘরের একাধিক কর্মসূচির। এর মধ্যে আরো রয়েছে স্বেচ্ছায় রক্তদান, বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়, সাপ্তাহিক বক্তব্য ও বিতর্ক চর্চার আসর, জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক দিবস উদ্যাপন, চিত্রাংকন, মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন, দেশ ও জাতির ইতিহাস ভিত্তিক উপস্থিত সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতা ইত্যাদি।
বাতিঘর’র অন্যতম উদ্যোক্তা মো. মাস-উদ-হাসান, মুহাম্মদ গোলাম মোস্তফা ও মাসুদ আহমদ জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পণ করার পর আমরা অনুভব করি আমাদের এই জনপদ শিক্ষার মানের দিক দিয়ে পিছিয়ে রয়েছে। অথচ সমাজের শিক্ষিত তরুণদের প্রচেষ্টায় এ থেকে উত্তরণ সম্ভব। এ চিন্তা থেকেই ‘বাতিঘর’র সৃষ্টি। শুরুর দিকে নিজেদের চাঁদায় ছোট ছোট কার্যক্রম পরিচালনা করি আমরা। পরবর্তীতে সংগঠনের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা বৃদ্ধি পাওয়ায় সকলের আর্থিক ও বুদ্ধিভিত্তিক সহযোগিতায় বাতিঘর তার কার্যক্রমের পরিধি বৃদ্ধি করেছে। আমরা বিশ্বাস করি তরুণদের একটি সমন্বিত প্লাটফর্ম হিসেবে বাতিঘর আরো বৃহৎ পরিসরে কাজ করার সক্ষমতা রাখে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বর্ণালী পাল বলেন, তরুণদের এই ভালো উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। বিশ্বনাথে শিক্ষার মান উন্নয়নে আমিও কাজ শুরু করছি। শিক্ষায় এ জনপদকে এগিয়ে নিতে আমরা বাতিঘরের পাশে আছি।
এ বিষয়ে কথা হলে সিলেটের জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা অনিল কৃষ্ণ মজুমদার ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’কে বলেন, এটি মহৎ কাজ। শিক্ষার মান উন্নয়নে তারা যে ভূমিকা রাখছেন, নিঃসন্দেহে তা প্রসংশার দাবি রাখে। শিক্ষার জন্যে এটি একটি বড় প্রসারণ বলে আমি মনে করি। শিক্ষার প্রসারে নিবেদিত প্রাণ ওই সংগঠনের সকলকে সাধুবাদ। এভাবে সকলে একযোগে কাজ করলে শিক্ষার আলোয় আলোকময় উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ে উঠবেই।
বিডি-প্রতিদিন/মাহবুব