রংপুরের পর সিলেটকে একসময় বলা হতো জাতীয় পার্টির দ্বিতীয় ঘাঁটি। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও সিলেটকে তার দ্বিতীয় বাড়ি হিসেবে পরিচয় দিতেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসন প্রাপ্তির দিক থেকেও দেশের বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে এগিয়ে থাকত দলটি। কিন্তু নেতৃত্বের দুর্বলতা, নেতাদের দলছুট নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতার কারণে জাতীয় পার্টির আগের সেই অবস্থান এখন আর নেই। সিলেটে এখন নেতারা ব্যস্ত নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব আর পদ বাগিয়ে নেওয়ার রাজনীতিতে। সংগঠনের দিকে নজর নেই কারও। গেল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সব উপজেলায় একটি করে ইউনিয়নেও দলীয় প্রার্থী দিতে পারেনি সংগঠনটি। অনেক নেতা দলীয় মনোনয়ন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কাছ থেকে সুবিধা গ্রহণ করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন এমন অভিযোগও উঠেছে দলের ভিতরে।
দলীয় সূত্র জানায়, সিলেট জেলা জাতীয় পার্টির সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। সম্মেলনস্থলে সেলিম উদ্দিনকে সভাপতি ঘোষণা করা হয়। পরে আবুল কাশেম মন্টুকে সাধারণ সম্পাদক করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন দেয় কেন্দ্র। দুই বছরের মাথায় ২০১৫ সালে এই কমিটি ভেঙে দেওয়া হয় নতুন আহ্বায়ক কমিটি। আহ্বায়ক কমিটি ভাঙাগড়ার খেলায় কেটেছে ৭ বছর। এই ৭ বছরে ৩টি প্রস্তুতি কমিটি হলেও সম্মেলনের দেখা পাননি দলের নেতা-কর্মীরা। সর্বশেষ কুনু মিয়াকে আহ্বায়ক ও ওসমান আলীকে সদস্য সচিব করে কমিটি দিয়ে জেলা জাতীয় পার্টির সম্মেলনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিন মাসের আহ্বায়ক কমিটি এক বছর পার করলেও সম্ভব হয়নি সম্মেলন আয়োজনের।
এদিকে শুরুতে কুনু ও ওসমানের সমন্বয়ে দলীয় কার্যক্রমে কিছুটা ইতিবাচক হাওয়া বইলেও গেল ইউপি নির্বাচন থেকে জেলা জাতীয় পার্টির শীর্ষ দুই নেতার মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী নির্বাচন নিয়েও দ্বন্দ্বে জড়ান আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব। এর জের ধরে বিরোধ তুঙ্গে ওঠে উপজেলা ও পৌর কমিটি গঠনে। সদস্য সচিব ছাড়া আহ্বায়ক নিজে একা বিভিন্ন উপজেলা কমিটি অনুমোদন দেন। অন্যদিকে আহ্বায়কের মতামত ছাড়া সদস্য সচিব বিভিন্ন কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের এমন বৈপরীত্য কর্মকান্ডে তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও বিব্রতবোধ করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিলেট জেলা জাতীয় পার্টির এক নেতা বলেন, জাতীয় পার্টির বর্তমান রাজনীতি বোঝা খুবই কষ্টসাধ্য। কেন্দ্র থেকে কোন সময় কাকে নেতা বানানো হয়, আবার কার চেয়ার কোন সময় কেড়ে নেয় এটা বোঝা খুব মুশকিল। এ জন্য তৃণমূলের কর্মীরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন।
দলের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে সিলেট জেলা জাতীয় পার্টির সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য সেলিম উদ্দিন বলেন, তিনি সভাপতি থাকাকালে সব উপজেলা কমিটি গঠন করেছিলেন। এরপর গেল ৭ বছরে কেউ তৃণমূল জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেননি। তিনি সভাপতির দায়িত্বে থাকাকালে পৌর মেয়র, কাউন্সিলর, ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বার পদে দলীয় প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। কিন্তু এখন দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সঠিক নেতৃত্বের অভাবে সিলেটে জাতীয় পার্টির অবস্থান দিন দিন দুর্বল হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি। গেল ইউপি নির্বাচনে সিলেট জেলার ১০৫টি ইউপির মধ্যে মাত্র ৩৬টিতে চেয়ারম্যান প্রার্থী দিতে পেরেছে জাতীয় পার্টি। এর মধ্যে পাস করেছেন মাত্র দুজন। দলীয় মনোনয়ন নিয়ে এসেও মনোনয়নপত্র জমা দেননি তিন প্রার্থী। অভিযোগ রয়েছে- তারা দলীয় মনোনয়ন এনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এ ছাড়া দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে পদবিধারী নেতাদেরও প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে। দলের মধ্যে সমন্বয়হীনতা প্রসঙ্গে জেলা জাতীয় পার্টির সদস্য সচিব ওসমান আলী বলেন, আহ্বায়ক তার ইচ্ছামতো একক স্বাক্ষর ও সিদ্ধান্তে কমিটি দিচ্ছেন। তিনি আসলে জাতীয় পার্টির আদর্শে কতটুকু বিশ্বাসী সেটাই প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ ২০০৫ সালে তিনি জেলা সভাপতির দায়িত্ব পাওয়ার কয়েক মাসের মাথায় বিএনপিতে যোগদান করেছিলেন। তিনি ড্রইংরুমবন্দি রাজনীতি করতে চান। দলের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় সাংগঠনিক কার্যক্রম প্রায় বন্ধ রয়েছে বলে জানান তিনি। বিষয়টি কেন্দ্র ও বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমকে অবগত করা হয়েছে বলে জানান ওসমান। সদস্য সচিবের এসব অভিযোগ অস্বীকার করে কুনু মিয়া বলেন, তিনি আহ্বায়কের দায়িত্ব পাওয়ার পর সিলেটে সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার হয়েছে। প্রায় সবকটি উপজেলা ও পৌরসভায় কমিটি দেওয়া হয়ে গেছে। এখন সম্মেলনের প্রস্তুতি চলছে বলে জানান তিনি।
বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ