চট্টগ্রাম নগরের বন্দর এলাকার ৩ ফকির হাট রোডে আগে জলাবদ্ধতা হতো না। কিন্তু আজকের প্রবল বর্ষণে ওই এলাকা তলিয়ে যায়। নগরের বড়পুল থেকে নিমতলা পর্যন্ত সড়কে অতীতে সামান্যই পানি জমলেও আজ সাড়ে ৫ কিলোমিটারের এ সড়কে হাঁটুজল হয়েছে। তাছাড়া হাঁটু পরিমাণ পানি জমেছে মুরাদপুর থেকে লালখানবাজার পর্যন্ত ফ্লাইওভারে।
এবারের বর্ষা মৌসুমের প্রথম ভারী বর্ষণে এভাবে নগরের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। মূল সড়ক পার হয়ে উপসড়ক ও গলিতেও হয়েছে নগরের অভিশাপ খ্যাত এ জলাবদ্ধতা। পথে পথে অন্তহীন দুর্ভোগে পড়ছেন মানুষ। বিপাকে পড়েছে শিক্ষার্থী ও অফিসগামী কর্মকর্তা-কর্মচারিরা। হয়েছে দেয়াল ধ্বস। সড়কে ভেঙ্গে পড়েছে বৃক্ষ। টানা বর্ষণে বিভিন্ন সড়কে পানি জমে বিঘিœত হয়েছে যানবাহন চলাচল। সৃষ্টি হয়েছে সীমাহীন যানজট। এ যানজট মূল সড়ক পেরিয়ে ঢুকেছে উপসড়কে। তাছাড়া পানি ঢুকেছে বাসা, দোকান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, অফিস ও কাঁচাবাজারে। টানা বৃষ্টিতে রয়েছে পাহাড়ধসের শঙ্কা।
জানা যায়, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) প্রতিবছর জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণে নগরের নালা-নর্দমা ও ড্রেন পরিস্কার করে। কিন্তু এবছর চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চলমান মেগা প্রকল্পের কারণে চসিক পরিস্কারের কাজটি করেনি, করেছে কেবল রুটিন। তাছাড়া চলমান মেগা প্রকল্পের কারণে কর্ণফুলী নদীর সংযোগ থাকা চারটি খালের মুখ প্রায় অচল। এর সঙ্গে আছে ওয়াসার অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ি। ফলে নগরের পানিগুলো সহজে প্রবাহিত হতে না পারায় দ্রুত জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে।
ছবি- দিদারুল আলম
নগরবাসীর অভিযোগ, দুই সেবা সংস্থার দায়িত্বহীনতার কারণে এবার নগরবাসীকে জলাবদ্ধতার ভয়ানক রূপ দেখতে হচ্ছে। তারা যদি প্রত্যাশিত দায়িত্ব পালন করত, তাহলে জলাবদ্ধতা অন্তত এমন ভয়াবহ অবস্থা ধারণ করত না। পরিস্থিতি আরো অনেক সহনীয় থাকত।
বহদ্দারহাট খাজা রোডের বাসিন্দা ডা. হামিদ হোসাইন আজাদ বলেন, ‘বহদ্দরহাট থেকে খাজা রোড চৌধুরী স্কুল পর্যন্ত সড়কে প্রায় বুক সমান পানি জমেছে। শঙ্কা হলো, এসব পানি অত্যন্ত কাঁদা ও ময়লাযুক্ত। এসব পানিতে চলাচল করলে চর্ম রোগসহ নানা সমস্যা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি।’
চসিকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) সুদীপ বসাক বলেন, ‘মেগা প্রকল্পের কারণে চসিক রুটিন-কাজ ছাড়া জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণে বড় বরাদ্দের নালা-নর্দমা পরিস্কারের কাজ করেনি। ফলে অনেক জায়গায় পানি জমে থাকার খবর শুনেছি।’
তিনি বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসন বা নিয়ন্ত্রণে যেকোনো মূল্যে পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় যত প্রকল্পই নেয়া হোক না কেন জলাবদ্ধতা নিরসন সম্ভব হবে না।’
সিডিএ’র মেগা প্রকল্পের পরিচালক আহমেদ মঈনুদ্দিন বলেন, ‘জলবাবদ্ধতা কমাতে সেনাবাহিনীর পাঁচটি রেসপন্স টিম মাঠে কাজ করছে। তাছাড়া প্রবর্তক মোড়, দুই নম্বর গেটসহ এ ধরণের জায়গায় কেন বেশি পানি জমে এবং এর কারণ কী তার বের করে সমাধানের পথ বের করতে একটি কনসালটেন্ট টিম কাজ করছে।’
পতেঙ্গার আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, গত শনিবার থেকে বৃষ্টির পরিমাণ বেড়েছে। গত রবিবার রাত চট্টগ্রামে ভারী বর্ষণ শুরু হয়ে সোমবার বিকাল পর্যন্ত টানা বৃষ্টি হয়। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের সহকারি আবহাওয়াবিদ প্রদীপ কান্তি নাথ বলেন, ‘সোমবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ১৩৬ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়। সমুদ্র বন্দরগুলোকে ৩ নং সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান কার্যালয়ের নিচতলা, চট্টগ্রাম মা-শিশু জেনারেল হাসপাতালের নিচতলায় হাঁটু পানি উঠে যায়। বর্ষণে নগরীর প্রায় সব নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়। ফলে সংকট দেখা দিয়েছে গণপরিবহনের। পানির মধ্যে অটোরিকশা, ব্যক্তিগত গাড়ি নামলেও বিকল হয়ে দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে অনেককে। পানিতে ভাসছে চকবাজার, বহদ্দারহাটসহ আশাপাশের কাঁচাবাজারগুলো। পানি ঢুকেছে নগরের বিভিন্ন মার্কেটের নিচতলা, বিভিন্ন নিচু এলাকার কলোনি ও ভবনের নিচতলার বাসাগুলোতে। তাছাড়া নগরের হালিশহরের নয়াবাজার, বড়পুল, এক্সেস রোড, নিমতলা থেকে বড়পুল মোড়, ওয়াসা, মেহেদিবাগ, প্রবর্তক, অক্সিজেন মোড়, মুরাদপুর, মোহাম্মদপুর আবাসিক এলাকা, ২ নম্বর গেইট, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা, বহদ্দারহাট, বাদুরতলা, পাঁচলাইশ, শুলকবহর, কাপাসগোলা, কাতালগঞ্জ, বাকলিয়ার কেবি আমান আলী রোড, কালামিয়া বাজার, চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ কোরবাণিগঞ্জ, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, বাকলিয়াসহ নগরের বড় এলাকাজুড়ে পানি থৈ থৈ করছে। কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কোমর পানি, কোথাও কাঁদাযুক্ত পানিতে ভাসছে নগরের সড়ক-উপসড়ক এবং অলিগলি।
চকবাজারের বাসিন্দা কামাল উদ্দিন বলেন, ‘বৃষ্টি হলেই নগর পানিতে তলিয়ে যায়। এটি অতীত অভিজ্ঞতা। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নগরের নালা-নর্দমা ও ড্রেনগুলো পরিস্কার না করায় এমন অবস্থা হয়েছে বলে আমরা মনে করছি। আমরা কী কেবলই দুঃখ দুর্দশার মধ্যে দিনাতিপাত করব।’
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএ) ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লক্ষ ৯০ হাজার টাকার একটি, চসিক এক হাজার ২৫৬ কোটি ১৫ লাখ টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। তাছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এক হাজার ৬২০ কোটি ৭৩ লাখ টাকার একটি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন।
বন্দর পরিস্থিতি
বন্দরের পরিবহন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এনসিটি, সিসিটি ও জিসিবি বার্থের জাহাজে কনটেইনার হ্যান্ডলিং স্বাভাবিক রয়েছে। তবে প্রবল বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে (বঙ্গোপসাগর) বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে খাদ্যশস্যসহ বৃষ্টিতে ভিজলে নষ্ট হয় এমন খোলা পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে। চার শতাধিক লাইটার কর্ণফুলী নদীতে বসে আছে।
ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) নির্বাহী পরিচালক মাহবুব রশীদ বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে খাদ্যশস্যসহ বৃষ্টিতে ভিজলে নষ্ট হয় এমন খোলা পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে। তবে পাথর জাতীয় কিছু পণ্য দু-চারটি লাইটার জাহাজে খালাস হয়েছে। বৈরী আবহাওয়ায় সাগর উত্তাল থাকলে বিদেশি জাহাজের পাইলটরা লাইটারিং বন্ধ করে দেন।’
দু’টি দেয়াল ধস
প্রবল বর্ষণে নগরে দুটি দেয়াল ধসের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে একটি চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সীমানা দেওয়া এবং অপরটি হেমসেন লেইন ১ নম্বর গলির নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের সীমানা প্রাচীর। সকালে ভারি বৃষ্টিপাতের সময় এ ঘটনা ঘটে। তবে দেয়াল ধসে কোথাও কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে নির্মাণ করায় জেনারেল হাসপাতালের সীমানা দেয়ালটির ধ্বংস হয়।
কোতয়ালী থানার এএসআই মিজানুর রহমান বলেন, ‘বৃষ্টির পানিতে পুরোনো একটি দেয়াল ধসে যায়। ৯৯৯ নম্বরে ফোন পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে যাই। তবে ভবনের মালিক নিজস্ব লোকজন দিয়ে ভাঙ্গা দেয়াল সরিয়েছে।
জেলা প্রশাসনের উদ্যোগ
প্রবল বর্ষণে নগরের ১৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় ধসের শঙ্কা থাকে। এ কারণে পাহাড় ধসে প্রাণহানি ঠেকাতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে পাহাড় থেকে অন্যত্র সরাতে ৬ সহকারি কমিশনার এবং জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখাকে বিশেষ দায়িত্ব দেয়া, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় মাইকিং, প্রয়োজনীয় শুকনো খাবার সংগ্রহে রাখা। তাছাড়া রেড ক্রিসেন্ট চালু করেছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ এবং জেলা সিভিল সার্জন গঠন করেছেন মেডিকেল টিম।
জেলা প্রশাসনের সহকারি কমিশনার তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ইতোমধ্যে ঝুকিপূর্ণ পাহাড় থেকে ৩৬১টি পরিবারকে সরিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। আরও যারা আছে তাদেরকেও সরানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে।’
যানজটে নাকাল
নগর পুলিশ জানায়, বৃষ্টির কারণে নগরীর অধিকাংশ সড়কে যানজট তৈরি হয়। কাপ্তাই রাস্তারার মাথা, বদ্দারহাট, মুরাদপুর, শোলকবহর এলাকা, দুই নং গেট, অক্সিজেন, জিইসি মোড় থেকে খুলশী, শিল্পকলা এলাকার মোহাম্মদ আলী রোড, ওযারলেস গেট মুরগি ফার্ম, প্রবর্তক মোড়, চকবাজার, ডিসি রোড, ওয়াসা মোড, নিউমার্কেট থেকে আমতলা, নিউ মার্কেট থেকে বিআরটিসি মোড়, চৌমুহনী থেকে কদমতলী মোড়, আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড় থেকে এক্সেস রোড, সদরঘাট মোড়, সল্টগোলা ক্রসিং, ইপিজেড থেকে বন্দরটিলাসহ বিভিন্ন এলাকায় যানজট তৈরি হয়।
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা