করোনার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধিতে নতুন ঢেউ আসার পর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এক সপ্তাহের লকডাউন সোমবার থেকে শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় করোনা আবারও ছড়িয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের অসচেতনতার কারণে।
বর্তমানে নগরীর বাইরে উপজেলা পর্যায়েও ছড়াচ্ছে নতুন করে করোনার ঢেউ। লকডাউনের প্রথম দিনেই অফিসগামীসহ সাধারণ মানুষের চলাচলে যানবাহন সংকটে চট্টগ্রামে পথে পথে দুর্ভোগ এবং তাছাড়া তুলনামূলক গাড়ি শূন্য এক প্রকার রিকশার নগরীতে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি এলাকায় রিকশা আর রিকশা। প্রতিটি রিকশায় ভাড়াও নেওয়া হচ্ছে দ্বিগুণের বেশি।
অন্যদিকে, ১১ এপ্রিল পর্যন্ত যাত্রীবাহী সব ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকলেও পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করবে। সাতদিনের লকডাউন, অথচ সীমিত পরিসরে খোলা সরকারি, বেসরকারি অফিস ও পোশাক কারখানা। আবার বন্ধ রয়েছে অধিকাংশ গণপরিবহনও। ফলে সকাল থেকে অফিসগামী মানুষকে পোহাতে হয়েছে দুর্ভোগ। সচেতনতা বৃদ্ধি এবং করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মাঠে নেমেছেন প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মমিনুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারের ১১টি নির্দেশনা বাস্তবায়নে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়মিত টহল শুরু হয়েছে। নির্দেশনা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, চট্টগ্রামে ১০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট লকডাউন কার্যকর করতে মাঠে রয়েছেন। এছাড়া নগরীর তিনটা প্রবেশ পথে বিআরটিএ’র ম্যাজিস্ট্রেটরা দায়িত্ব পালন করছেন।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রুহুল আমীন বলেন, আমরা নমুনা বেশি পাঠিয়েছি। সে কারণে শনাক্তও বেশি হয়েছে। বর্তমানে উপজেলা পর্যায়েও বাড়ছে করোনার সংক্রমণ। তবে সচেতনতার জন্য কঠোরভাবে মাঠে থেকে কাজ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
ব্যবসায়ী ও যুবনেতা সারজু মো. নাছের বলেন, লকডাউনে শ্রমজীবী মানুষ পড়েছেন দুর্ভোগে। সকাল থেকে চকবাজার, পাথরঘাটা, ২ নম্বর গেইট, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, আগ্রাবাদ বাদামতলীসহ বিভিন্ন স্থানের মোড় এলাকায় কাজের সন্ধানে শ্রমিকরা জড়ো হন। কাজ না পেলে দিনের অন্ন সংস্থান কিভাবে হবে-তা নিয়ে চিন্তিত তারা। একই কথা বললেন সুমন দেও।
সংগঠক মাহমুদুর রহমান শাওন বলেন, সীমিত আকারে অফিস খোলা রেখেছে। কিন্তু যাতায়াতের কোনো ব্যবস্থা নেই। রাস্তায় নামলেই যাত্রীদের দুর্ভোগের শেষ নেই। সিটিং সার্ভিসে গাদাগাদি করে যাত্রীদের নেওয়া হচ্ছে। করোনার সংক্রমণের ভয়ে এসব বাসে ওঠার সুযোগও নেই।
চট্টগ্রাম নগরীর বাইরে জেলায়ও বাড়ছে সংক্রমণ
গত রবিবার পর্যন্ত চট্টগ্রামে করোনা শনাক্তদের মধ্যে ২০ দশমিক ২৩ শতাংশ উপজেলা পর্যায়ে। আবার উপজেলার মধ্যে সর্বোচ্চ ২২ দশমিক ৫৪ শতাংশ হাটহাজারীতে। এর আগে গত ২৭ মার্চ মোট করোনা সংক্রমিতের ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ ছিল উপজেলা পর্যায়ের বাসিন্দা। বাকি ৮৯ দশমিক ০৯ শতাংশ ছিল নগরীর।
গত শনিবারের ফলাফলে দেখা গেছে, মোট আক্রান্তের ১৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ উপজেলার এবং ৮২ দশমিক ৪৪ শতাংশ নগরের বাসিন্দা। এতে দ্রুত উপজেলা পর্যায়েও আক্রান্তের হার বাড়ছে। উপজেলার বাসিন্দাদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা বেশি হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে।
করোনা ফলাফল বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, করোনা সংক্রমিত হয়েছেন সাড়ে ৪১ হাজার জন। এর মধ্যে ১৪ উপজেলার বাসিন্দা আছেন ৮ হাজার ৩৯৮ জন। এর মধ্যে নগরীর বাসিন্দা ৩৩ হাজার ১০২ জন। চট্টগ্রাম দক্ষিণের চেয়ে উত্তরে বেশি সংক্রমিত হচ্ছে। রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মোট শনাক্তের ৫ হাজার ৪১০ জন উত্তর চট্টগ্রামের সাত উপজেলার বাসিন্দা। সর্বোচ্চ শনাক্ত তিন উপজেলা তথা হাটহাজারী, রাউজান ও ফটিকছড়ি। এছাড়া সীতাকুন্ড, বোয়ালখালী, পটিয়া, আনোয়ারা, মীরসরাই, লোহাগাড়া, সন্দ্বীপ, রাঙ্গুনীয়া ও বাঁশখালীতে অনেক শনাক্ত হয়েছেন।
লকডাউনে পথে পথে দুর্ভোগ
চট্টগ্রামে লকডাউনের প্রথম দিন কাজের প্রয়োজনে ভোর থেকেই নিজ নিজ গন্তব্যস্থলে গেছেন সাধারণ মানুষ। গণপরিবহন কমে যাওয়ায় শিল্প-কারখানার শ্রমিকরা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বের হয়। জরুরি কাজের জন্য সীমিত পরিসরে সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অফিস ও আদালত এবং বেসরকারি অফিস খোলা হয়েছে।
বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান নিজস্ব ব্যবস্থায় কর্মীদের অফিসে আনা-নেওয়ার জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করেছে। এছাড়া নির্মাণকাজ চালু রাখায় শ্রমিকদের পায়ে হেঁটে ও রিকশায় যেতে হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে। অভ্যন্তরীণ পথে বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় বিমানবন্দরমুখী সড়কে নেই যাত্রীদের যাতায়াত। বহদ্দারহাট, দামপাড়া, কদমতলী, অলংকার বাস টার্মিনাল ও রেলস্টেশনে নেই টিকিট প্রত্যাশীদের ভিড়।
ব্যবসায়ীদের বিরোধিতা
লকডাউনের বিরোধিতা করে দোকানপাট খোলা রাখার দাবিতে সোমবারও নগরীর শপিং মল, রেয়াজউদ্দিন বাজার, টেরি বাজারসহ বিভিন্ন মার্কেটের ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা মানববন্ধন করলেও তাতে সাড়া মিলেনি। ফলে বন্ধই রাখতে হচ্ছে এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। স্বাস্থ্যবিধি মেনে মুদি দোকানগুলোতে কেনা-বেচা চলছে। এই লকডাউনে বিরোধিতা করে বিক্ষোভ করেছেন ব্যবসায়ীরা।
সোমবার তামাকুমন্ডি লেইনে হাজারও ব্যবসায়ী রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দোকান-পাট খোলা রাখার দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন তামাকুমন্ডি লেইন বণিক সমিতির নেতারা।
এসময় তারা ‘অবৈধ লকডাউন মানি না, মানবো না’, ‘এই মুহূর্তে দোকান খুলে দাও, খুলতে হবে’ শ্লোগান দেন। লকডাউন তুলে না নিলে আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও দেন নেতারা। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন তামাকুমন্ডি লেইন বণিক সমিতির সভাপতি আবু তালেব, সিনিয়র সহ-সভাপতি সরওয়ার কামাল, সাধারণ সম্পাদক আহমদ কবির দুলাল ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুজাম্মেল হক প্রমুখ।
বিডি প্রতিদিন/এমআই