তিন বছর বয়সী কন্যা রুহীকে কোলে নিয়ে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার কোস্টগার্ড জেটিতে এসেছিলেন শামীমা ইয়াসমিন। প্রায় এক মাস পর স্বামী ’লায়লা-২’ ফিশিং বোটের চিফ ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ রাসেল রানাকে কাছে পেয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলেন তিনি। শামীমা ছাড়াও সেখানে অপেক্ষা করছিলেন অন্য নাবিকদের স্বজনরা। এক অনিশ্চিত অবস্থা শেষে প্রিয়জনকে কাছে পেয়ে তারাও ভাসছিলেন খুশির জোয়ারে। এ যেন ঈদের আনন্দ!
ভারতে বন্দিদশা থেকে মুক্ত বাংলাদেশি তিনটি ফিশিং ট্রলারের ৯০ জন নাবিককে সোমবার রাতে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার কোস্ট গার্ড জেটিতে আনা হয়। আজ মঙ্গলবার সকালে আত্মীয়-স্বজনের কাছে তাদের হস্তান্তর করা হয়। এদিকে ফেরত আনা দুটি ট্রলারও হস্তান্তর করা হয় মালিকদের কাছে।
গত ৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমারেখা সংলগ্ন এলাকায় ভারতীয় জলসীমায় মৎস্য আহরণের অভিযোগে ৭৮ নাবিকসহ এফবি লায়লা-২ ও এফবি মেঘনা-৫ আটক করে নিয়ে যায় ভারতীয় কোস্টগার্ড। এর আগে গত ৯ সেপ্টেম্বর বৈরি আবহাওয়ায় বাংলাদেশি ফিশিং বোট এফবি কৌশিক ডুবে গেলে ১২ জন জেলেকে ভারতীয় একটি বোট উদ্ধার করে সেদেশের হলদিয়া বন্দরে নিয়ে যায়। পরে তাদের ঠাঁই হয়েছিল কারাগারে। গত রবিবার দুই দেশের মধ্যে বন্দি বিনিময়ের আওতায় বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের কাছে তিনটি নৌযানের ৯০ জন বাংলাদেশি নাবিক-জেলেকে হস্তান্তর করা হয়। অপরদিকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ফেরত দেওয়া হয় আটক ৬ টি বোটসহ ৯৫ ভারতীয় জেলেকে।
কোস্ট গার্ড পূর্ব জোনের কমান্ডার ক্যাপ্টেন জহিরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতে আটক নাবিকদের ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নেয়। দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার ভিত্তিতে বন্দি বিনিময়ের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই প্রেক্ষাপটে ভারতে আটক ৯০ বাংলাদেশিকে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে।
আটকদের ফেরত পেয়ে পরিবারের সদস্যরা উল্লসিত।এফবি লায়লা-২ এর চিফ অফিসার হুমায়ুন কবীরের স্ত্রী সুরাইয়া বলেন, অনেক টেনশনে ছিলাম। দুই শিশু কন্যাকে নিয়ে কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। এখন স্বামীকে কাছে পেয়ে আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া প্রকাশ করছি। আমি অনেক খুশি।
যেভাবে আটক :
এফবি লায়লা-২ এর স্কিপার রাজিব চন্দ্র শীল বলেন, ৯ ডিসেম্বর সকালে আমরা বাংলদেশ সীমানার কাছাকাছি ছিলাম। এসময় ভারতীয় কোস্টগার্ড আমাদেরকে জাহাজ থামাতে বলে। তারা তল্লাশির পর ৪১ জন ক্রুসহ আমাদের ট্রলার ভারতের প্যারা দ্বীপে নিয়ে যায়। সেখানে মারধর বা খারাপ ব্যবহার করেনি। খাবার ও ওষুধ দিয়েছে প্রয়োজন মতো। একদিন শুধু আমাদেরকে জাহাজ থেকে নামানো হয়েছিল। এছাড়া জাহাজেই ছিলাম। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারতের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছিল। হয়তো সে কারণেই আমাদেরকে জেলে দেয়নি।
মেঘনা-৫ এর ক্যাপ্টেন রাহুল বিশ্বাস বলেন, বর্ডার লাইন থেকে আমাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। শারীরিকভাবে সুস্থ ছিলাম। তবে বিপর্যস্ত ছিলাম মানসিকভাবে। কখন মুক্তি পাব, দেশে ফিরব কবে, আদৌ ফিরতে পারব কিনা এ নিয়ে দুশ্চিন্তা হতো।
বাঁশ ধরে সাগরে ২০ ঘণ্টা
৯ সেপ্টেম্বর কুয়াকাকাটা এলাকায় মাছ ধরতে যায় এফবি কৌশিক। ওইদিনই বৈরি আবহাওয়ার কবলে পড়ে সাগরে উল্টে যায় ট্রলারটি। ওই সময়কার বিভীষিকাময় অবস্থার বর্ণনা দিয়ে ট্রলারটির ক্রু মো. শরীফ মিয়া বলেন, আমরা ১৩ জন ছিলাম। একজনকে পাইনি। বাকি ১২ জন ১০-১২ হাত লম্বা একটি বাঁশ ও ৩০-৪০ টি পুলুট(জাল ভাসিয়ে রাখার ছোট প্লাস্টিক বয়া) ধরে টানা ২০ ঘণ্টা পানিতে ভেসেছিলাম। পরদিন সন্ধ্যায় ভারতীয় একটি বোট এসে আমাদের উদ্ধার করে। আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। ওষুধ ও খাবার দিয়ে সুস্থ করে তোলে। ভারতে নিয়ে আমাদের থানায় সোপর্দ করা হয়। সেখান থেকে আদালতের মাধ্যমে নেওয়া হয় ডায়মন্ড হারবার জেলে। সেখানে তিন মাস ২১ দিন ছিলাম। ১২ জন পরিবারের কাছে ফিরে এসেছি। আনন্দ লাগছে। কিন্তু ইব্রাহিম নামের নিখোঁজ সহকর্মী ও তার পরিবারের জন্য কষ্ট হচ্ছে।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল