ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রবীণ-নবীনের আড্ডা-আনন্দ এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠেছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। দুই দিনব্যাপী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠান শনিবার শেষ হয়েছে। প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্ণ করেছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় এ বিদ্যাপীঠ। রঙ-বেরঙের ধরনের ব্যানার, ফেস্টুন হাতে একই রকমের টি-শার্ট, বিভিন্ন ব্যাচের শিক্ষার্থীরা নানা স্লোগানে ব্যানার নিয়ে র্যালিতেও অংশ নিয়েছেন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন-প্রবীণের সেই শিক্ষার্থীদের মিলনমেলায় রূপ নিয়েছে। প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে চবির সেই ঝুপড়িতে যেতেও ভুল করেননি। মিলিত হয়ে জমে তুললো সেই স্মৃতির আড্ডায়ও। একজন আরেকজনের স্মৃতির কথা তুলে ধরেন বলে জানান চবির প্রাক্তন শিক্ষার্থী জোবেদা আক্তারসহ অনেকেই।
সুবর্ণজয়ন্তী আয়োজক কমিটির সদস্য সাংবাদিক চৌধুরী ফরিদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী এ উৎসবে যোগ দিয়েছে। শোভাযাত্রায় হাজার হাজার শিক্ষার্থীর উপস্থিতি দেখে আমাদের আয়োজনকে সফল মনে হচ্ছে। এর চেয়ে বেশি আনন্দের আর কিছুই হতে পারে না। তিনি বলেন, গৌরবময় ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত সুবর্ণজয়ন্তী সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। ক্যাম্পাসে প্রায় ত্রিশ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র মহিউদ্দিন, সুজিদ সাহা, ওমর ফারুক বলেন, চবির সুর্বণজয়ন্তীতে আজ এতো বেশি আনন্দ লাগছে যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এখানে প্রবীন-নবীনের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। নতুন পুরাতনের এ সম্মিলনে আমরা আনন্দিত।
চবির সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে ছিল আলোচনা সভাও। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত স্মৃতিসহ নানাবিধ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন বক্তারা। প্রাক্তন বন্ধুদের মিলনমেলায় মুখরিত ছিল সেই বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনও। চিরচেনা সেই স্থানগুলোতেও যেতে ভুলেননি বন্ধুরা।
গান আর আড্ডায় মুখরিত চবির সেই ঝুপড়ি:
চবির এ গৌরবের ৫০ বছর পুর্তিতে সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থীরা গান আর আড্ডায় মুখরিত ছিল চবি কলা অনুষদের সেই ঝুপড়িটি। ঝুপড়ির আগের সেই চিরচেনা রূপ না থাকলেও সাবেক শিক্ষার্থীদের জমজমাট গান আর আড্ডায় যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে ঝুপড়ি। এতে বর্তমান শিক্ষার্থীদের চেয়ে প্রাক্তনদের উপস্থিতিই বেশি লক্ষণীয়। অনেকেই দল বেঁধে বসে গেছেন দোকানে। কেউ টেবিল চাপড়িয়ে গান গাইছেন, কেউ চুমুক দিচ্ছেন চায়ের কাপে, আবার কেউ বা মেতে রয়েছেন আড্ডায়। এতে অনেকেই এসে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছেন, আর পুরনো বন্ধু, পরিচিত মুখ খুঁজে নিতে বেছে নিয়েছেন ঝুপড়িটি।
চবির ৩৮তম ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং বর্তমানে চবি চারুকলা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক অসীম রায় বলেন, শিক্ষাজীবনের অধিকাংশ সময় ঝুপড়িতে কাটিয়েছি। আজ আবার শিক্ষক নয়, আগের মতন শিক্ষার্থী হয়ে আসতে পেরে ভীষণ ভালো লাগছে। বিভিন্ন অনুষদের বন্ধুদের খুঁজে পেতেই মূলত এসেছি। একই কথা বললেন চবির প্রাক্তন ছাত্র ও চট্টগ্রাম সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রফেসর হুমায়ন কবির। তিনি বলেন, আমি ও আমার স্ত্রী দুইজনই চবির শিক্ষার্থী ছিলাম। আজ একসঙ্গে এসেছি সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করতে। বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পেরে বেশ ভালো লাগছে।
চবি’র কনসার্টে রুনা লায়লা:
চবির সুবর্ণজয়ন্তী বা পথচলার ৫০ বছর পূর্ণ অনুষ্ঠানে প্রথম দিনের কনসার্টে অংশ নিয়েছেন দেশের কালজয়ী শিল্পী রুনা লায়লা। এতে রুনা লায়লাসহ অন্য শিল্পীরা সন্ধ্যা থেকেই বিভিন্ন শিল্পীরা মাতিয়ে রাখেন প্রবীণ-তরুণদের।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী:
সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, এখানে এসে আমি যেন আমার ছাত্রজীবনে ফিরে গেছি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই ক্যাম্পাসে আসার সময় আমি দেখেছিন প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা দলে দলে আসছেন। তিনি বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা আজ দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। ৫০ বছর পর হয়তো আমাদের অনেকেই থাকব না। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয় তার জ্ঞান বিতরণ করেই যাবে। যুগ যুগ ধরে যেন এভাবেই এই ধারা চলমান থাকে।
প্রফেসর ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান:
উপস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, যেখানে শত শত বৎসরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, সেখানে পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করা কিছু নয়। তবুও এদেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় যখন এখনো শতবর্ষ অতিক্রম করেনি, সেখানে আমাদের ৫০ বর্ষপূর্তি একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা বটে। তবে এটা যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বের দিকেই আমাদের তাকাতে হবে। আমাদের লক্ষ্য হবে জগতের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো হয়ে ওঠা। তার জন্যে সাধনা ও শৃঙ্খলা চাই, স্বপ্ন ও অধ্যবসায় চাই। আমার বিশ্বাস, সেখানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পেছনে পড়ে থাকবে না।
চবির উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দীন চৌধুরী:
আলোচনা সভায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, সুবর্ণজয়ন্তীতে যদি কোন ভুল-ত্রুটি হয়, তাহলে সব দোষ আমার। এ উপলক্ষে ঢাকা-চট্টগ্রামে ২৯টি সভা করেছি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা অনুষ্ঠানকে সফল করতে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে যাচ্ছি। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখার জন্য।
সভায় বক্তব্য রাখেন পানি সম্পাদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি, সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, চবির সাবেক উপাচার্য এজেএম নুরুউদ্দীন চৌধুরী, ওয়াশিকা আয়েশা খান এমপি, চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম। শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর সুকান্ত ভট্টাচার্য ও নাসরিন আক্তারের সঞ্চালনায় সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কামরুল হুদা। সভাশেষে সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্পিকার ড. শিরিন শারমিন বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে অনুষ্ঠানকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। এরপর শুরু হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত ও নাট্যকলা বিভাগের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।
দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের প্রথমদিন শুক্রবার নগরীর বাদশা মিয়া সড়কে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে শোভাযাত্রা শুরু হয়। চবির শিক্ষকরাও মিলেছেন বন্ধুত্বের বন্ধনে। অধিকাংশ শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যানারে যোগ না দিয়ে নিজ নিজ ব্যাচের সঙ্গে অংশ নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠেন। ওইদিন বিকেল সাড়ে ৩টায় র্যালিটি চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে যাত্রা শুরু হওয়া র্যালীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছেন। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে সিআরবির শিরীষতলায় শেষ হবে র্যালি। এছাড়া সন্ধ্যায় জি ই সি কনভেনশন সেন্টারে প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের আয়োজনে মনোরম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী রুনা লায়নাসহ দেশের বিভিন্ন শিল্পীরা।
বিডি-প্রতিদিন/ ১৯ নভেম্বর, ২০১৬/ আফরোজ-১৫