ডিজনি সিনেমার রাজকণ্যাদের অপরূপ চুল থেকে দৃষ্টি সরানোটা খুব কষ্টকর। সিন্ডারেলা, স্নো হোয়াইট অথবা জেসমিনদের মতো অপরূপ চুলের সাজে কে না সাজতে চায়! কিন্তু সেজন্য দরকার সুস্থ এবং উজ্জ্বল চুল।
আমাদের দেশের আবহাওয়ার বর্তমান যে অবস্থা তাতে চুলকে সুস্থ রাখতে পারাটাই একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ! সুন্দর চুলের জন্য যে খুব ব্যয়বহুল লাইফস্টাইল অথবা প্রোডাক্টস ব্যবহার করতে হয় এমনটা কখনই নয়। প্রয়োজন শুধু নিয়মিত পরিচর্যা আর সঠিক পুষ্টি।
যারা প্রতিদিন কাজের জন্য বাইরে বের হন, তাদের সবসময় চেষ্টা করা উচিত সূর্যের আলো, রোদ এবং বৃষ্টি থেকে চুলকে সুরক্ষিত রাখা। সূর্যের কড়া রোদ, তাপ, ধুলোবালি ইত্যাদি ধীরে ধীরে চুলের গোড়াতে জমাট বাঁধে, ফলস্বরূপ শুরু হয় চুল পড়া। চুলের এই দুর্দশা থেকে রেহাই পেতে রোদ-বৃষ্টিতে চলাচলের সময় ছাতা অথবা ক্যাপ পরা উচিত। ভেজা চুল সবথেকে ভঙ্গুর অবস্থায় থাকে। তাই গোসলের পরপরই চুলে চিরুনি ব্যবহার থেকে বিরত থাকা উচিত। এসব সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে এখন সবাই হারবাল উপাদানে তৈরি পণ্য কিনছেন বা হারবাল উপাদান দিয়ে ঘরে তৈরি প্যাক ব্যবহার করছেন। সুতরাং চুলকে হেলদি আর স্টাইলিশ করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি এখন ঘরে বসেই তৈরি করতে পারেন।
অতিরিক্ত তাপও চুল ভেঙে যাওয়ার অন্যতম কারণ, একারণেই চুলে হিট না দেয়াটা ভালো। অতিরিক্ত হিটের কারণে চুল জ্বলে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এজন্য ব্লোয়ার, আয়রন অথবা চুল স্ট্রেটনার যদি ব্যবহার করতেই হয় তাহলে তা খুব সাবধানে করা উচিত। চুলের পরিপূর্ণ পুষ্টি যোগাতে অয়েল ম্যাসাজের বিকল্প নেই। তাই যারা চুলে নিয়মিত হিট দিয়ে স্টাইল করে থাকেন, তারা চুলের ক্ষতি রোধ করতে ইদানিং হারবাল উপাদানে তৈরি তেলের দিকে ঝুঁকছেন। কারণ তারা জানেন এসকল তেল চুলের জন্য খুবই উপকারি।
প্রতিদিনের আবহাওয়া, ধুলোবালি, ময়লা, অযত্ন আর অবহেলার কারণে আমাদের চুল প্রাণ হারিয়ে ফেলে, হয়ে যায় রুক্ষ-শুষ্ক। তখন ভালোমানের শ্যাম্পু এবং কন্ডিশনার ব্যবহারের পরেও চুল সেই আগের মতো হয়ে ওঠে না। তাই এই চুলগুলোকে রুক্ষতা দূর করে সুন্দর ও শাইনি করার জন্য ব্যবহার করা উচিত হারবাল হেয়ার অয়েল। আমলকি ব্রাহ্মী মুকুবেন্না ও ভেটিভার এর মিশ্রণে যে তেল তৈরি হয় তা ইন্সট্যান্টলি রুক্ষ-শুষ্ক চুলকে করে তোলে শাইনি এবং সফট। আঁচড়াতে গেলেই জট বাধার কারণে যাদের প্রচুর চুল পড়ে যায় তাদের জন্যে হেয়ার অয়েলটি ম্যাজিকের মতো কাজ করে। তাই এখন সৌন্দর্য বিশেষজ্ঞ ও তারকারা হারবাল অয়েল ব্যবহার করছেন। ভবিষ্যতে এর ব্যবহারের পরিমাণ আরও ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চুল সুন্দর করতে ও চুল পড়া বন্ধ করতে অ্যালোভেরা জেল ব্যবহার করতে পারেন। অ্যালোভেরা ত্বকের যত্নে বিশেষভাবে কাজ করে, আর চুলকে করে মজবুত ও ঝলমলে। তাই চুলের উজ্জ্বলতা ধরে রাখতে দই ও অ্যালোভেরা ব্যবহার করুন।
দুই চামচ টক দইয়ের সঙ্গে এক চামচ অ্যালোভেরা মিশিয়ে প্রায় ১০ মিনিট ধরে মাথার ত্বকে মাসাজ করুন। এছাড়াও একটি ডিমের কুসুম ও দুই চামচ অ্যালোভেরার সঙ্গে এক চামচ অলিভ অয়েল মিশিয়ে চুলে লাগিয়ে ৩০ মিনিট পর চুল শ্যাম্পু করে ধুয়ে নিন। এতে চুলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি হবে ও চুল পড়া বন্ধ হবে। অ্যালোভেরায় প্রচুর পরিমাণে ময়েশ্চারাইজার থাকে, যা চুলকে খুব সুন্দরভাবে কন্ডিশন করে আর খুশকির সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়।
প্রাকৃতিক গুণাগুণ সম্পন্ন ফল আমলকীর মধ্যেও চুলের বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের পর্যাপ্ত যোগান রয়েছে। প্রাকৃতিক ভিটামিন, মিনারেল ও বিভিন্ন খনিজ উপাদানে ভরপুর আমলকী চুলের যত্নে বেশ কার্যকরি। চুলকে গোড়া থেকে মজবুত করতে আমলকির জুড়ি নেই। মেহেদি পাতার সাথে আমলকির গুঁড়ো একটি ডিমসহ এক সাথে খুব ভালোভাবে মেশান। ডিমের গন্ধ এড়াতে এর সাথে গরম তেল ও লেবুর রস মেশান। এবার চুলের গোড়ায় গোড়ায় প্যাকটি লাগিয়ে নিন। আমলকি চুলের টনিক হিসেবে এবং চুলের পরিচর্যার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে। এটি চুলের গোড়া মজবুত করার পাশাপাশি চুলের বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে। চুলের আগা ফেটে যাওয়া এবং চুল পেকে যাওয়া সমস্যার সমাধানে আমলকির তেলের ব্যবহার বহুল প্রচলিত।
এছাড়া আমলকিতে অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল গুণাগুণ থাকে যা চুলে খুশকি, উঁকুনের মতো একাধিক সমস্যার প্রতিরোধ করে। চুলের পুষ্টি এবং চুলকে শক্তিশালী করতে আমলকির বিকল্প কিছু নেই। আমলকি চুলের কন্ডিশনার হিসেবেও কাজ করে। যার ফলে চুল হয়ে উঠে চকচকে আর আকর্ষণীয়। আমলকি ব্যবহারের ফলে চুলের খুশকি দূর হয়ে যায়। এতে থাকা ভিটামিন-সি ডান্ড্রিয়াম আক্রমণে বাধা দেয় ও চুলে পাক ধরা প্রতিরোধ করে।
ব্রাহ্মী লতা প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টি। এর ওষুধি গুণ চুলের জন্য দারুণ উপকারি। ব্রাহ্মী লতাকে বাকোপা মনৌরিও বলা হয়। ব্রাহ্মী মিশ্রিত তেল ব্যবহারে চুল পড়া কমে। এটি স্ক্যাল্পকে নারিশ করে চুলের মরা কোষে শক্তি জোগায়। এর ফলে চুল বাড়তে সাহায্য করে এবং নতুন চুলের জন্ম হয়। আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরিতে ব্রাহ্মী লতা সুপরিচিত নাম, চুলের তো বটেই, সাথে শরীরের নানা অসুখে ওষুধি হিসেবেও ব্রাহ্মী বেশ উপকারী। ব্রাহ্মী পাউডারের নিয়মিত ব্যবহার স্ক্যাল্পে ময়েশ্চারাইজার যুগিয়ে চুলের গোড়া শক্ত করে, চুল ঘন করে চুল বাড়াতে সাহায্য করে এবং মাথা ঠাণ্ডা রাখে। খুশকি দূর করতেও ব্রাহ্মী তুলনাহীন। ঘরে বসেই আপনি ব্রাহ্মী হারবাল প্যাক তৈরি করতে পারেন। শুধু শ্যাম্পু বা তেল নয়, চুলকে আরো আকর্ষণীয় ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল করতে হলে বিভিন্ন ঘরোয়া উপকরণ দিয়ে তৈরি প্যাক লাগাতে পারেন।
প্রথমেই আপনার চুলের ধরন ও সমস্যা চিহ্নিত করুন। চুল তৈলাক্ত হলে বেশি তেল দেয়ার প্রয়োজন নেই, এতে চুল আরো তেল চিটচিটে হয়ে যাবে। তৈলাক্ত চুলের জন্য আমলকি, টকদই ও লেবুর রস অনেক কাজে দেয়। শুষ্ক চুলের জন্য হেয়ার প্যাকে তেলের প্রয়োজন হবে। তাছাড়া পাকা কলা আর পেঁপের পেস্টও শুষ্ক চুলের জন্য ভালো। খুশকি ও চুল পড়া রোধ করতে আমলকি ও টকদইয়ের প্যাক বেশ উপকারি।
প্রাকৃতিক উপাদানে রয়েছে প্রচুর পরিমানে ওষুধি গুণ, যার কারণে প্রতিনিয়ত হারবাল পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সর্ব স্তরের নারীরা চুলের যত্নে বেছে নিচ্ছেন হারবাল উপাদানে উৎপাদিত তেল। তাছাড়া আপনার স্বাস্থ্য আপনার চুলে প্রতিফলিত হয়। আপনি স্বাস্থ্যকর থাকলে, ভাল থাকবে চুল। তাই সুন্দর চুল রাখতে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া আবশ্যক। আর তাই আপনার চুলের বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যের জন্য ভিটামিন, লোহা এবং প্রোটিন এর মত পুষ্টিকর খাবার নিয়মিত গ্রহণ করুন। বেশি বেশি প্রোটিন জাতীয় শাক-সবজি চুল ভালো রাখতে সহায়তা করে, এছাড়াও প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন