ভারতের দিল্লির প্রাণকেন্দ্র সদাব্যস্ত কনট প্লেসে রবিবার সকাল থেকে কোনো জনপ্রাণীর দেখা নেই। সারি সারি দোকানের শাটার নামানো, মেট্রো স্টেশনের কলাপসিবল গেটে বিশাল তালা ঝুলছে। পালিকা বাজার, সরোজিনী নগর মার্কেট বা লাজপত নগরও জনশূন্য।
যে পার্কিং লটে জায়গা পেতে প্রতিদিন নাভিশ্বাস ওঠে, সেটা বিলকুল খালি। রিং রোডে পর্যন্ত গাড়ির দেখা নেই, চাইলে সেখানে ক্রিকেট ব্যাট-বল নিয়ে নেমে পড়া যাবে- এতটাই ফাঁকা দিল্লির প্রধান আর্টারিয়াল রোড।
একশো ৩০ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার একটা দেশে সব মানুষকে যেন রাস্তাঘাট থেকে বেমালুম সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, মুছে ফেলা হয়েছে স্বাভাবিক জনজীবনের প্রতিটি ছোটখাটো চিহ্ন।
বিধ্বংসী করোনাভাইরাসের মোকাবেলায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আহ্বানে এভাবেই আজ 'জনতা কারফিউ' পালন করছে সারা দেশ।
ভারতীয়দের রবিবার সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত টানা ১৪ ঘণ্টা কঠোরভাবে বাড়ির ভেতরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। আর স্বেচ্ছা গৃহবন্দিত্বের এই সময়কালটুকু বর্ণনা করতে তিনি নিজেই চয়ন করেছেন এই 'জনতা কারফিউ' শব্দবন্ধটি।
অত্যাবশ্যকীয় বিভাগের সেবাকর্মীরা ছাড়া কেউ যেন এই কারফিউ-র মধ্যে বাইরে না-বেরোয়, সেটা নিষেধ করেছেন।
শুধু তা-ই নয়, রবিবার ঠিক বিকেল ৫টায় নিজেদের বাড়ির দরজা বা জানালার সামনে এসে কিংবা ব্যালকনিতে বেরিয়ে সজোরে হাততালি দিয়ে, শঙ্খনাদ করে, দরকারে থালা-বাসন বাজিয়ে সম্মিলিতভাবে কলতান সৃষ্টিরও অনুরোধ করেছেন তিনি।
১৪ ঘণ্টার 'জনতা কারফিউ' করোনাভাইরাস ছড়ানো রুখতে 'চেইন'-টা ভাঙতে পারবে কি না, তা নিয়েও ভারতে শুরু হয়েছে তর্কবিতর্ক।
সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেকেই আবার মন্তব্য করছেন, ভারত অবধারিতভাবে একটা সম্পূর্ণ লকডাউনের দিকে এগোচ্ছে - তার আগে আজ রবিবারের এই জনতা কারফিউ আসলে একটা মহড়া বা 'ড্রেস রিহার্সাল'!
তবে এটা ঠিক, 'সামাজিক দূরত্ব' (সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং) বজায় রাখার প্রশ্নে কিংবা নিজেকে ঘরে আটকে রাখার প্রশ্নে মাত্র কদিন আগেও ভারতজুড়ে যে এক ধরনের গা-ছাড়া মনোভাব দেখা যাচ্ছিল, আজকের জনতা কারফিউ সেই মানসিকতাকে সমূলে আঘাত করেছে।
একান্ত প্রয়োজন ছাড়া দেশের ভেতরেও এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সফর করার যে কোনও দরকার নেই- সরকার সেটা বেশ কড়া বার্তা দিয়ে দেশবাসীকে বুঝিয়ে দিয়েছে।
গোটা ভারতের 'লাইফলাইন' বলে ধরা হয় যে ভারতীয় রেলকে, তারাও আজ জনতা কারফিউ-র দিনে কোনো যাত্রীবাহী ট্রেন চালাচ্ছে না। শুধু যে দূরপাল্লার ট্রেনগুলো গতকালই রওনা দিয়েছে, সেগুলো চলছে - তবে মাঝের কোনো স্টেশনে যাত্রাবিরতি ছাড়াই।
কিন্তু এই সব আয়োজন কি মাত্র এক দিনের জন্য, না কি আগামীতে এরকম আরও প্রলম্বিত 'জনতা কারফিউ'-র জন্য মানুষকে প্রস্তুত থাকতে হবে, ভারত তা এখনও ঠাহর করে উঠতে পারছে না।
এদিকে জনতা কারফিউ আর তাতে হাততালি বাজানোর ডাক নিয়ে রাজনৈতিক বাগবিতণ্ডাও থেমে নেই।
শাসক দল বিজেপি ও তার সমর্থকরা যথারীতি প্রধানমন্ত্রীর পদক্ষেপকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানাচ্ছেন। ওদিকে বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী আবার টুইটে কটাক্ষ করেছেন, 'দেশের ছোট ও মাঝারি ব্যবসাগুলো এবং দিনমজুররা প্রবল সঙ্কটে আছেন - শুধু তালি বাজালে তাদের কোনো লাভ হবে না!'
দিল্লির শাহীনবাগে গত একশো দিন ধরে বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন যে মুসলিম নারীরা, তারা অবশ্য এই ব্যাখ্যা মানছেন না - জনতা কারফিউ-র ডাক অগ্রাহ্য করে তারা আজও তাদের ধরনা জারি রেখেছেন, যদিও অনেক সংক্ষিপ্ত আকারে।
তাদের কেউ কেউ মিডিয়া কর্মীদের বলেছেন, "আমরা ডিটেনশন সেন্টারকে আসলে যে কোনো রোগের চেয়েও বেশি ভয় করি, তাই এই আইন তুলে না-নেওয়া পর্যন্ত আমাদের প্রতিবাদ চলবে।"
শাহীনবাগের একটু দূরে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার বর্তমান ও সাবেক ছাত্রছাত্রীরাও নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসি-র বিরুদ্ধে লাগাতার প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন, কিন্তু আজ জনতা কারফিউর দিনে তারা সেই আন্দোলন সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করেছেন।
বিডি প্রতিদিন/এনায়েত করিম