যশোরের দুঃখ হিসেবে পরিচিত ভবদহ এলাকায় তিন উপদেষ্টার সফরের পর আশায় বুক বাঁধছেন ভুক্তভোগী তিন উপজেলার ১০ লক্ষাধিক মানুষ। তারা আশা করছেন, অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চলা ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধতা সমস্যার এবার স্থায়ী সমাধান হবে। সংশ্লিষ্টরা জানায়, জোয়ারের সঙ্গে আসা লোনাপানি ঠেকিয়ে ফসলি জমি রক্ষার জন্য ৬০-এর দশকে যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলার নদী ও বিলগুলোতে ছোট-বড় অনেক স্লুইস গেট নির্মাণ করা হয়। সবচেয়ে বড় ২১ ভেন্টের স্লুইস গেটটি নির্মাণ করা হয় অভয়নগর উপজেলার ভবদহ এলাকায়। এ পরিকল্পনা যে টেকসই ছিল না তা কয়েক বছর পরই বোঝা যায়। পানি বিলে প্রবেশ করতে না পারায় নদীর বুকেই পলি জমতে থাকে। আস্তে আস্তে ভরাট হয়ে উঁচু হতে থাকে নদীর তলদেশ। কিন্তু পাশের বিলগুলো নিচুই থেকে যায়। নদী ভরাট হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে অভয়নগর, মনিরামপুর, কেশবপুর উপজেলার বিশাল অংশের পানি নেমে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় স্থায়ী জলাবদ্ধতা, যার শিকার হন প্রায় ১০ লাখ মানুষ। যেহেতু প্রধান স্লুইস গেট ভবদহে, আর এ কারণেই এ জলাবদ্ধতা, তাই তিন উপজেলার জলাবদ্ধ এলাকা ভবদহ জলাবদ্ধ এলাকা হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত বছর ১০ নভেম্বর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ভবদহ জলাবদ্ধ এলাকা পরিদর্শন করেন। সে সময় স্থানীয়দের কাছ থেকে মতামত নিয়ে দ্রুত বাড়িঘর ও কৃষিজমি থেকে পানি নামানোর জন্য স্থানীয় আমডাঙ্গা খাল সংস্কার ও সেচের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশনের নির্দেশ দেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের। ২২ এপ্রিল উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীর প্রতীককে নিয়ে ভবদহ এলাকা পরিদর্শন করেন ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন।
এ দিন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ভবদহবাসীকে আশ্বস্ত করে বলেন, এবার সরকার ভবদহ জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথে হাঁটছে।
এ জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। সে কারণেই তিন উপদেষ্টার একসঙ্গে ভবদহ এলাকা পরিদর্শন।অভয়নগর উপজেলার সুন্দলী পূর্বপাড়ার বাসিন্দা অলোক বিশ্বাস বলেন, কিছুদিন আগে তার শোবার ঘরে পর্যন্ত পানি ছিল। গরু বাঁচাতে ইট-বালি দিয়ে গোয়াল ঘর উঁচু করতে হয়েছিল। তার পরও প্রতিদিন পানি সেচতে হতো। তিনি বলেন, ‘আমরা তো হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। তিন উপদেষ্টা আসার পর আমাদের মনে আশার সঞ্চার হয়েছে, এবার হয়তো সমাধানটা হবে’। ডহর মশিহাটি গ্রামের নিপুণ মণ্ডল বলেন, ‘কিছুদিন আগ পর্যন্তও আমার বাড়িতে বুক সমান পানি ছিল। চাষের জমিও ছিল পানির নিচে। মাছ চাষ করেছিলাম, সব ভেসে যায়’। নিপুণ বলেন, ‘এখন যিনি পানি সম্পদ উপদেষ্টা, তিনি একসময় ভবদহ জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধানে আমাদের সঙ্গেই আন্দোলন করেছিলেন’। নিপুণ বলেন, ‘স্থায়ী সমাধানের জন্য সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নদী খনন ও আমডাঙ্গা খাল প্রশস্ত করাসহ আরও যেসব পরিকল্পনা নিচ্ছে সরকার, সেগুলো ঠিকঠাকমতো হলে ভালো কিছু হবে বলে আমরা আশা করছি’।
ভবদহ এলাকার মুক্তেশ্বরী ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক এবং ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির সদস্যসচিব চৈতন্য পাল বলেন, ‘ভবদহ এলাকার তিন উপজেলায় ২৫ হাজার হেক্টর কৃষি জমি জলাবদ্ধ ছিল। পানিসম্পদ উপদেষ্টার চেষ্টায় এবার ১৬ হাজার ৬৫৭ হেক্টর জমিতে ফসল হয়েছে’। তিনি বলেন, ‘ভবদহ সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা আছে। তবে বিভিন্ন কারণে কাজ শুরু করতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। যত দেরি হবে, সমস্যা ততই জটিল হয়ে যাবে’।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ইকবাল কবীর জাহিদ বলেন, তিন উপদেষ্টার একসঙ্গে ভবদহ এলাকা সফল নিঃসন্দেহে ইতিবাচক অগ্রগতি। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানের ভবদহ এলাকার নদীগুলো খননের বিষয়টি পানিসম্পদ উপদেষ্টা বলেছেন। আমডাঙ্গা খাল প্রশস্তকরণের ব্যাপারে টেন্ডারও হয়ে গেছে। টিআরএমের (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট বা জোয়ারাধার) বিষয়ে সমীক্ষার কাজ চলছে। এগুলোর অগ্রগতি হলে সুফল পাওয়া যাবে’। তিনি বলেন, ‘নদী খনন, আমডাঙ্গা খাল প্রশস্তকরণ এবং টিআরএমের মাধ্যমে ভবদহ সমস্যার আপাতত সমাধান হবে, তবে স্থায়ী সমাধানের জন্য উজানে ভৈরব নদকে মাথাভাঙ্গা নদের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে’। ‘ভৈরব নদ চুয়াডাঙ্গার জীবননগর পর্যন্ত ড্রেজিং করা আছে। এরপর মাত্র ১১-১২ কিলোমিটার সংস্কার করলেই মাথাভাঙ্গার সঙ্গে ভৈরবের সংযোগ সম্ভব’।