কয়েক বছর ধরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর যে আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে এসেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবের মুখ দেখল। গতকাল ভোররাতের দিকে তাদের হামলায় ইরানের রাজধানী তেহরানসহ বেশ কয়েকটি শহর কেঁপে উঠেছে। সমাজমাধ্যমে আসা অসংখ্য ছবিতে ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনা থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা গেছে। এদিন ইরানের বেশ কজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানীর প্রাণও গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ও গাড়ির ছবিতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো সয়লাব।
বিশ্লেষকদের ধারণা, ইরান আরও বড় আকারে প্রতিশোধ নেবে, যা পুরো অঞ্চলকেই যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে। তেমনটা হলে তাতে যুক্তরাষ্ট্রও জড়িয়ে পড়বে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র। সাম্প্রতিক দিনগুলোয় ইউরোপের অনেক মিত্রের সঙ্গে তেল আবিবের টানাপোড়েন চললেও ওয়াশিংটনের কাছ থেকে তারা সব সময়ই ইরান ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে সমর্থন পেয়ে এসেছে। কেবল তা-ই নয়, ইসরায়েলে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র সরবরাহ করা দেশও যুক্তরাষ্ট্র। গতকালের হামলায় ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া বিমান ব্যবহারের কথাও গর্বভরেই বলছে। এ হামলা যে হতে পারে তার ইঙ্গিত মিলছিল কয়েক দিন ধরেই। ওয়াশিংটন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে জরুরি নয়, এমন কর্মীদের সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও ইরানে ইসরায়েলের হামলা ‘আসন্ন’ বলে বারবারই সতর্ক করছিল। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল ভোররাতে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কারখানা এবং সামরিক কমান্ডারদের লক্ষ করে হামলা শুরু করে তেল আবিব। কয়েক দফায় শতাধিক হামলায় তারা ইরানের অন্তত আটটি স্থাপনার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছে বলে দাবি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর। ইসরায়েলি হামলায় ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও রাডারেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
তেল আবিবের ভাষ্য, তেহরান যাতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে একটি দীর্ঘমেয়াদি অভিযানের শুরু হিসেবে এ হামলা চালাল তাদের সামরিক বাহিনী। খবরে বলা হয়, সমরশক্তি বিবেচনায় পশ্চিমা দেশগুলো সমর্থিত ইসরায়েল এগিয়ে থাকলেও ইরানের শক্তি হচ্ছে তাদের ‘প্রতিরোধ অক্ষ’। যে অক্ষে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি থেকে শুরু করে ইরাক ও সিরিয়ায় ক্রিয়াশীল অনেক মিলিশিয়া গোষ্ঠী রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতিতে ইসরায়েলের প্রভাব যে এখন সবচেয়ে বেশি তা বেশির ভাগ লোকই মানবে। অনেক আরব দেশ মুখে তাদের স্বীকৃতি না দিলেও গোপনে ঠিকই সম্পর্ক রেখে চলেছে। ইরানের প্রভাব নিয়ে চিন্তিত সৌদি আরবসহ সুন্নি দেশগুলো প্রায়ই ইরানবিরোধী তেল আবিবের নানান পদক্ষেপে ‘পরোক্ষ সহায়তা’ করে এসেছে। এসব দেশের বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। যে কারণে আটলান্টিক কাউন্সিলের মিডল ইস্ট প্রোগ্রামের অনাবাসিক জ্যেষ্ঠ ফেলো রিচার্ড লে’বেরন মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র না চাইলেও মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের যুদ্ধ হলে তাকে তাতে জড়িয়ে পড়তেই হবে। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা চলতে থাকলে ওয়াশিংটনকে অবশ্যই তেল আবিবের পাশে থাকতে হবে, যদিও দৃশ্যত তারা কূটনীতির মাধ্যমেই তেহরানের পরমাণু কর্মসূচির সমাধান চেয়েছিল, বলছেন লে’বেরন। নানান ধরনের ‘সম্ভাব্য দৃশ্যপট’ তৈরি হলেও পুরোটাই যে ইরান ও তার মিত্রদের সক্ষমতা এবং তাদের প্রতিক্রিয়ার ধরনের ওপর নির্ভর করছে, সে বিষয়ে একমত প্রায় সবাই। পাশাপাশি বড় ধরনের আঞ্চলিক যুদ্ধ বেধে গেলে তা যে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য, বিশেষ করে তেল সরবরাহে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে তা নিয়েও তারা বেশ উদ্বিগ্ন। সূত্র : এএফপি, রয়টার্স, বিবিসি