৩০টি রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সংলাপের শেষ দিকে এসে প্রশ্ন উঠছে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের। কোন প্রক্রিয়ায় বা কীসের ভিত্তিতে সনদ বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে নানা মন্তব্য করছে রাজনৈতিক দলগুলো।
জামায়াত, এনসিপিসহ সমমনা দলগুলো জুলাই সনদের জন্য এখন আইনি ভিত্তি চাচ্ছে। তারা বলছে, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হচ্ছে তা নিয়ে তৈরি হবে জুলাই সনদ আর এতে আমাদের স্বাক্ষর করার কথা। কিন্তু কীসের ভিত্তিতে স্বাক্ষর করব। অন্যদিকে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো এর বিরোধিতা করছে। সংলাপে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে এ প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। কিন্তু কমিশন এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো জবাব দিতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের জানান, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজের কাছে আমরা প্রশ্ন তুলেছিলাম। জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টা তাদের টার্মসে নেই। তখন আমরা বলেছিলাম, প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে টার্মস নিয়ে আসেন অথবা আমাদের বক্তব্য প্রধান উপদেষ্টার কাছে জানান। পরে আলী রীয়াজ রাজনৈতিক দলগুলোকে এ বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানান তারা।
গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দ্বিতীয় দফার ২২তম বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা শুরু হয়। বৈঠকের শুরুতে স্ক্রিনে সাতটি আলোচ্য বিষয় দেখানো হয়। আলোচ্য সূচিতে রাখা বিষয়গুলো ছিল- সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব, সরকারি কর্মকমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সম্পর্কিত, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব [অনুচ্ছেদ ৪৮(৩), রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপদ্ধতি ও ইলেকটোরাল কলেজ ইত্যাদি, উচ্চকক্ষের গঠন, সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি ও এখতিয়ার ইত্যাদি, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ সম্পর্কিত প্রস্তাব এবং রাষ্ট্রের মূলনীতি। সংলাপের বিরতিতে সংস্কারের প্রস্তাবগুলোর আইনি ভিত্তি না থাকলে তা বাস্তবায়নযোগ্য হবে না বলে জানিয়েছেন জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। তিনি বলেন, জনগণের কাছে এর কোনো মূল্য থাকবে না। আমাদের দীর্ঘ আলোচনার পর যে সংস্কার প্রস্তাবগুলোয় একমত হয়েছি, তা যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়, তাহলে বাংলাদেশে একটি গুণগত পরিবর্তন সম্ভব। কিন্তু কমিশনের পক্ষ থেকে যে সনদের খসড়া পাঠানো হয়েছে, তা দেখে আমরা খুব হতাশ হয়েছি। সেখানে বলা হয়েছে, দুই বছরের মধ্যে এসব সংস্কার বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু সরকারের মেয়াদ বা কমিশনের এখতিয়ার সম্পর্কিত কোনো সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। তিনি বলেন, এ সরকার কি তাহলে দুই বছর ক্ষমতায় থাকতে চায়? যদি বর্তমান সরকার না থেকে পরবর্তী সরকার এসব বাস্তবায়ন করে, তাহলে এতদিন ধরে আমরা যে পরিশ্রম করেছি তা কি কেবল পরামর্শ দেওয়ার জন্যই ছিল? তাহলে তো এর কোনো মূল্যই থাকল না। আমরা শুরু থেকেই ধরে নিয়েছিলাম, এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো আইনি ভিত্তি পাবে এবং তা বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক হবে। কিন্তু যদি আইনি ভিত্তি না থাকে, তাহলে এটি কেবল কথার কথা থেকে যাবে, যা জনগণ মানবে না, গুরুত্ব দেবে না।
নায়েবে আমির বলেন, কমিশনের চেয়ারপারসন ও বিএনপি নেতাদের মধ্যে আগে একটি লিখিত চুক্তি হয়েছিল, কিন্তু মাঠপর্যায়ে তার কোনো বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায়নি। কমিটমেন্ট না মানলে সেটি শুধু প্রতারণাই নয়, বরং জনগণের সঙ্গে উপহাস। তিনি বলেন, আমরা আইনজ্ঞদের নিয়ে একটি বৈঠক করতে চাই, যেখানে এ সংস্কার প্রস্তাবগুলো কীভাবে আইনি ভিত্তি পেতে পারে, তা আলোচনা করা হবে। এখনই সেই আলোচনার সুযোগ দিলে ভালো হয়, না হলে পরবর্তী সময়ে যেন সেই সুযোগ দেওয়া হয়। এ সনদের প্রস্তাব যদি বাস্তবায়নযোগ্য না হয়, আইনি ভিত্তি না থাকে, তাহলে তা শুধু একটি প্রতীকী দলিল হয়ে থাকবে। তাতে আমরা সই করব না, কারণ জনগণের কাছে যার কোনো বাস্তব মূল্য নেই, এমন প্রস্তাবে সই করে লাভ কী? এ প্রসঙ্গে জামায়াত নেতা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির বলেন, আমরা চাই এ সনদ ও প্রোক্লেমেশনকে সাংবিধানিক ঘোষণা হিসেবে প্রকাশ করা হোক। পরবর্তী সংসদে এটি র্যাটিফাই হলে কেউ আর আদালতে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না। এর মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্যের চূড়ান্ত আইনি ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, জুলাই সনদকে যদি আমরা একটা আইনি ভিত্তির জায়গায় নিয়ে আসতে না পারি, সে ক্ষেত্রে সেই জুলাই সনদ সেটা পূর্বেকার মতো তিন দলের রূপরেখার (৯১ সালের ঘটনা) মতো শুধু একটা ইতিহাসের দলিল হয়ে থাকবে। যার কোনো কার্যকারিতার জায়গা থাকবে না। আমরা একটা অকার্যকর, অপূর্ণাঙ্গ মৌলিক সংস্কারবিহীন জুলাই সনদ চাই না। একই সঙ্গে জুলাই ঘোষণাপত্র সেটাকে বাস্তবায়নযোগ্য করা, সেই বাস্তবায়নের ভিত্তিতেই সামনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। ৩৬ জুলাইয়ে মধ্যে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র এবং সনদপত্র ‘বাস্তবায়ন চাই। এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, পূর্ণাঙ্গ সনদ পেলে স্বাক্ষর করবে বিএনপি। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন জায়গা হবে আগামী জাতীয় সংসদ। বিভিন্ন অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাব বর্তমান সময়েই কার্যকর হয়ে যাবে। জাতিকে ধোঁকা দেওযার মতো কোনো রাজনৈতিক দল আছে বলে মনে করি না।
খসড়া সনদ সব দলের কাছে দেওয়া হবে আজ : আজ জুলাই সনদের গ্রহণযোগ্য খসড়া সব দলের কাছে তুলে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, বুধবারের মধ্যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেসব বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে, তার একটি তালিকা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পৌঁছে দেব। আশা করছি, বৃহস্পতিবার আমরা একটি সমন্বিত ও গ্রহণযোগ্য খসড়া সনদ সব দলের কাছে তুলে দিতে পারব।
আলোচনার গতি বাড়াতে দলগুলোর সহযোগিতা কামনা করে আলী রিয়াজ বলেন, ‘যেমনটি আপনারা শুরু থেকেই করে আসছেন, তেমন সহযোগিতার ধারাবাহিকতা আমরা আশা করছি।’ তিনি বলেন, ‘আপনারা যে দায়িত্ব আমাদের দিয়েছেন, তার মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমরা চেষ্টা করছি, এসব বিষয়ে দ্রুত ঐকমত্যে পৌঁছাতে এবং বৃহস্পতিবারের মধ্যেই আপনাদের অবহিত করতে পারব।’ সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব-সংক্রান্ত আলোচনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে এবং এ বিষয়ে একটি লিখিত খসড়া অংশগ্রহণকারী দলগুলোর কাছে তুলে দেওয়া হবে বলেও জানান আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক পর্যায়ে সব দল মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণের নীতিগত অবস্থানে একমত হয়েছে। তবে সংবিধানে এ বিষয়ে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে, তা নিয়ে কিছু ভিন্নমত রয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় বিএনপির দেওয়া সুপারিশ ও আপত্তিগুলো স্পষ্টভাবে কমিশনের কাছে তুলে ধরা হয়েছে এবং তা আলোচনাকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব নিয়ে প্রস্তাব এখনো প্রস্তুত না হলেও অন্য বিষয়গুলোয় দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর লক্ষ্যে আলোচনা চলছে বলে আলী রীয়াজ আশাবাদ ব্যক্ত করেন।