অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠিত বহুল আলোচিত লন্ডন বৈঠকের যৌথ বিবৃতি নিয়ে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। তারা বলছেন, বর্তমানে দেশের দুই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যকার এই বৈঠক রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে। তবে ব্যতিক্রম জুলাই গণ অভ্যুত্থান থেকে গড়ে ওঠা বিপ্লবীদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এ বৈঠককে গণ অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থি বলে অভিহিত করেছেন। গতকাল এক বিবৃতিতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন বলেছেন, অধ্যাপক ইউনূস এবং তারেক রহমানের বৈঠক ও বিবৃতি দেশের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে। এই উচ্চপর্যায়ের সংলাপ দেশে রাজনৈতিক সমঝোতা ও জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে গণ অভ্যুত্থানের কাঙ্ক্ষিত অভিপ্রায় অনুযায়ী রাষ্ট্র সংস্কার, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর এবং গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। বিবৃতিতে দ্রুত ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়নের আহ্বান জানিয়ে তারা আরও বলেন, আমরা এই ঐকমত্যের সূচনাকে স্বাগত জানাই। সেই সঙ্গে বাস্তবে সংস্কার ও বিচারের দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে চাই।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠকের ফলে দুই পক্ষই জিতেছে। উভয়পক্ষের মধ্যে থাকা বিভক্তি, সন্দেহ ও অবিশ্বাস কমেছে। নাটকীয় কিছু না ঘটলে এই ঐকমত্য দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। বিচার ও সংস্কারের গতি বাড়বে। নির্বাচনের তারিখও হয়তো দ্রুতই পেয়ে যাব। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, এই দুই নেতার বৈঠকটি ইতিবাচক। এই বৈঠক নির্বাচনের আস্থাপূর্ণ পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হবে। নির্বাচনের আস্থাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হলে এবং সময়সীমা-সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা দূর হলে সংস্কারে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হবে। এতে সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় সনদ তৈরি হবে এবং বিচার প্রক্রিয়া যে দৃশ্যমান হয়েছে, তা আরও ত্বরান্বিত হবে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেছেন, ফেব্রুয়ারি নয় ডিসেম্বরের মধ্যেই সব ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ ও বিচার সম্পন্ন করে নির্বাচন দেওয়া সম্ভব। তা না হলে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটবে না। তিনি আরও বলেন, গণ অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞে জড়িতদের বিচারের কাজ দৃশ্যমান করা এবং সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অবাধ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব। এদিকে রাজধানীর বাংলামোটরে এনসিপির অস্থায়ী কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, বিদেশের মাটিতে বসে যখন সরকার বিশেষ দলের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে বৈঠকে বসে তখন এটা হয়ে যায় গণ অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থি। সেখানে জুলাই ঘোষণার স্পষ্ট বার্তা দেখিনি। মৌলিক সংস্কার প্রশ্নেও বার্তা পাইনি। শুধু একটি দলকে খুশি করতে নির্বাচন এগিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে। দলটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেছেন, একটি দলের সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ পুনর্বিবেচনা করার মধ্য দিয়ে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করার আগে জুলাই আন্দোলনে ভূমিকা রাখা রাজনৈতিক দল, শহীদ পরিবারসহ সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করতে হবে। নির্বাচনের পূর্বে জুলাই ঘোষণাপত্র, জুলাই সনদ, বিচার ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে বলেও দাবি করেন তিনি। এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, ‘জাতীয় ঐকমত্যের প্রশ্নে, দেশের স্বার্থে সরকারের সঙ্গে সব রাজনৈতিক দলের এমন সুসম্পর্কই কাম্য। কিন্তু হতাশার বিষয় বৈঠকে নির্বাচনের মাস ও তারিখ যেভাবে গুরুত্ব পেয়েছে অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা বিচার ও সংস্কার সেভাবে প্রাধান্য পায়নি।’ গতকাল ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এসব কথা বলেন।
হাসনাত আরও বলেন, ‘জুলাই মাসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ, মৌলিক সংস্কার, দৃশ্যমান বিচার এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন নির্বাচনের পূর্বশর্ত। জুলাই সনদের আগে নির্বাচনের মাস আর তারিখ নিয়ে কথা বলা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের দায়বদ্ধতা ভুলে যাওয়ার নামান্তর। সনদ রচনার পরেই নির্বাচনবিষয়ক আলোচনা চূড়ান্ত হওয়া উচিত।’