স্বাধীনতার ছয়চল্লিশ বছরের অপেক্ষা আজও শেষ হয়নি ভাগ্যাহত সুনিতী রানী ঘোষের। স্বামী হারানোর বেদনার ঘনীভূত হয়েছে দিনে দিনে। স্বাধীনতার ৪৬ বছরে বদলেছে অনেক কিছু। শুধু কষ্ট আর আক্ষেপে মোড়ানো নিয়তিই বদলায়নি ৭০ বছরের বৃদ্ধা সুনিতী রানী ঘোষের। তার মৃত্যুর পর সন্তানের কি হবে তা নিয়ে চিন্তার বলিরেখা তার চোখেমুখে।
একাত্তরে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার উত্তর নাড়িবাড়ি গ্রামের শহীদ বিষ্টুপদ হালদারের স্ত্রী সুনিতী রানী ঘোষ স্বাধীনতার ৪৬ বছর ধরে অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে ছেলে সন্তান নিয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। অপেক্ষায় রয়েছেন শহীদ স্বামী বিষ্টুপদ হালদারের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির। এই ৪৬ বছরে কেউ তাদের খোঁজ নেয়নি। স্বামীর রেখে যাওয়া ছোট্ট একটি মাটির বাড়ি তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল।
ছোট্ট একটি মাটির কুড়ে ঘরে তিনি দিন পার করছেন। এক ছেলে অটোরিক্সা চালালেও সংসার চলে না সামান্য আয়ে। ছেলে যখন অটোরিক্সা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয় তখন অজানা আশংকায় দিন কাটে মা সুনিতী রানী ঘোষের। কোন দুর্ঘটনার খবর পেলেই আঁতকে ওঠেন ৭০ বছরে পা দেওয়া সুনিতী রানী ঘোষ। তার বুকের ধনের কোন খারপ খবর নেই এমন আশংকা ভর করে তাকে।
৭১ এ স্বামীকে রাজাকারদের সহায়তায় পাক সেনারা বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে পাশের একটি বাগানে গুলি করে হত্যা করে। নিজে চোখে স্বামীর রক্তাক্ত মৃত দেহ পড়ে থাকতে দেখেছেন তিনি। ওই দৃশ্য এখনও চোখের সামনে ভেঁসে বেড়ায়। একথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে চোখ ভাসিয়ে ফেলেন সুনিতী ঘোষ।
বয়স বেড়ে যাওয়ায় ডুকরেও কাঁদতে পারেন না। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, গ্রামবাসীদের কাছে শুনেছি তোমরা সাংবাদিকরা পারো আমার স্বামীর স্বীকৃতির ব্যবস্থা করে দিতে। যে যেখানে যেতে বলেছেন সেখানেই ছুটে গেছি। কিন্তু কিছুই মেলেনি। উপরন্তু কখনও কখনও কপালে গালমন্দ জুটেছে।
সুনিতী রানী ঘোষ শুধু একা নন। ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময় এই উত্তর নাড়িবাড়ি গ্রামের ১৭ হিন্দু বাঙ্গালীকে গুলি করে হত্যা করেছে পাক সেনারা। সুনিতী রানী ঘোষের স্বামী বিষ্টুপদ হালদার সহ হত্যা করা হয় শিক্ষক দীলিপ সরকার, মানিক মালাকার, নীল রতন, নবরাম মালাকার, মহেন্দ্রনাথ, ডা.সীতানাথ মালাকার, মহন্ত ডাক্তার ও তার ছেলে নীল রতন সরকার , সুরেশ মালাকার, সুধীর হালদার ও তার ছেলে সুবোধ হালদার, দুলাল মালাকার প্রমুখ।
শহীদ নবরাম মালাকারের স্ত্রী ছবি মজুমদার বলেন, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল দুপুর ১টার দিকে পাক সেনারা স্থানীয় পিস কমিটির নেতা কাশেম মাষ্টারের সহায়তায় তাদের গ্রাম ঘিরে
ফেলে। পাক সেনারা তাদের বাড়িতে ঢুকে তার স্বামী নবরামকে ধরে নিয়ে বাড়ির বাহিরে গ্রামেরই মহন্ত ডাক্তার ও নীল রতন সরকারকে এক সাথে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। তখন তার কোলে দু’বছরের ছেলে। আরো ১৪ জনকে অন্য জায়গার হত্যা করা হয়। এদিন এই গ্রামের ১৭ হিন্দু বাঙ্গালীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও কেউ তাদের খোঁজ নেয়নি। স্বাধীনতার পর তারা নিজেরাই শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য এলাকায় তিনটি স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে বা স্থানীয়ভাবেও কোন সহায়তা করা হয়নি এসব শহীদ পরিবারকে।
শহীদের ছেলে জয়ন্ত মালাকার আক্ষেপের সুরে বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন স্বীকৃতি তারা ৪৬ বছরেও পায়নি। শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে নিজেরা যে সব স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছিলেন সেগুলোও এখন দখল হয়ে যাচ্ছে। অযন্ত ও অবহেলায় রয়েছে সেগুলো।
স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মী দিল মোহম্মদ দিলু বলেন, তারা শুধু শুনেই আসছেন উত্তর নাড়িবাড়ি গ্রামে বেছে বেছে ১৭ হিন্দু বাঙ্গালীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার পর তাদের স্মরণে নির্মান করা স্মৃতিস্তম্ভে ভাষা দিবস সহ বিভিন্ন দিবসে পুস্পার্ঘ নিবেদন করেছেন। এখন সেগুলো অযন্ত ও অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর ৭১ এর ১৭ এপ্রিলের সেই বিভিষিকাময় কাহিনীর যারা শিকার হয়েছেন সে সব পরিবারের খোঁজ নেয়না কেউ। শহীদদেরও দেওয়া হয়নি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। আসলে সেদনি যা ঘটেছিল তার ইতিহাস কি সেটিও স্থানীয়ভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার চাঁদ মোহম্মদ জানান, এসব পরিবারের স্বীকৃতির জন্য বহুবার বিভিন্নভাবে আবেদন করা হয়েছে। কেন হয়নি তিনি জানেননা। তবে তিনি এসব পরিবারকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান।
গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মনির হোসেন বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সাংসদ ও মুক্তিযোদ্ধা সহ বিশিষ্টজনদের সাথে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।
বিডি প্রতিদিন/১৯ ডিসেম্বর ২০১৭/হিমেল