টাঙ্গাইলের রসুলপুরে তিনদিনব্যাপী জামাই মেলা আজ শেষ হয়েছে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা সংস্কৃতির সাথে মিশে আছে বাঙালির প্রাণ। তারই ধারাবাহিকতায় শত বছর ধরে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার রসুলপুর গ্রামে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ‘জামাইমেলা’। এ মেলাকে কেন্দ্র করে রসুলপুরসহ কয়েকটি গ্রামে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে।
এ মেলা উপলক্ষে মেলার ২/৩ দিন আগে থেকেই দূর দূরান্ত থেকে জামাইয়েরা আসেন শ্বশুর বাড়িতে। মেলায় জামাইরা বৌ ও শালা, শালিকে নিয়ে হাঁড়ি/ঝুড়ি ভরে সদাই করেন। আর মেলায় ছোট ছেলে-মেয়েদের জন্য রাখা হয় নানা বিনোদনের ব্যবস্থা। মেলায় থাকে ছোট-বড় প্রচুর স্টল, বিভিন্ন ধরনের খেলনা, কসমেটিকস, খাবারের দোকান। ঐতিহ্যবাহী এই মেলায় ব্যবসা করতেও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসেন ব্যবসায়ীরা। তবে দোকানীদের দাবি মেলাকে তিনদিনের স্থলে ৭ দিন করা হোক।
প্রতিবছর ১১, ১২ ও ১৩ বৈশাখ (সনাতন পঞ্জিকা অনুসারে) টাঙ্গাইলের সদর উপজেলার রসুলপুর বাছিরন নেছা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আয়োজন করা হয় এই মেলার। তিনদিনে রসলপুরসহ আশেপাশের অন্তত ৩০টি গ্রামের লাখো মানুষের সমাগম ঘটে এই মেলায়।
জামাইমেলার নামকরণ নিয়ে রসুলপুরের অনেকেই বলেন, এই মেলাকে কেন্দ্র করে এলাকার সব মেয়ের বর শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে আসেন, তারাই মেলার মূল আকর্ষণ। এ কারণেই মেলাটি জামাইমেলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
শনিবার শেষ দিন মেলায় ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন দোকানীরা তাদের জিনিসপত্র নিয়ে বসে আছে, অপরদিকে ক্রেতারা তা কিনছেন। এছাড়া মেলায় মিষ্টি জাতীয় দোকানের সংখ্যা বেশি লক্ষ করা গেছে। মেলায় বিভিন্ন রকমের জিনিসপত্র উঠেছে। মেলায় টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জেলার লোকজনকে দেখা যায়। বড়দের পাশাপাশি ছোট ছেলে মেয়েরা এই মেলা উপভোগ করে থাকে।
এ ব্যাপারে রসুলপুরের বাসিন্দা কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক রাশেদ রহমান বলেন, ‘এই মেলার উৎপত্তি কবে সেটা কেউ জানে না। যুগ যুগ ধরে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই এলাকার মানুষের কাছে ঈদ আর পূজাপার্বনের থেকেও এই মেলা বেশি উৎসবের। মেলাটি বৈশাখী মেলা হিসেবে ব্রিটিশ আমলে শুরু হলেও এখন এটি জামাইমেলা হিসেবে পরিচিত। মেলাকে সামনে রেখে রসুলপুর ও এর আশেপাশের বিবাহিত মেয়েরা তাদের বরকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে আসেন। আর মেয়ের জামাইকে মেলা উপলক্ষে বরণ করে নেবার জন্য শ্বশুড়-শাশুড়িরা বেশ আগে থেকেই নেন নানা প্রস্তুতি। মেলার দিন জামাইয়ের হাতে কিছু টাকা তুলে দেন শাশুড়িরা। আর সেই টাকার সাথে আরও টাকা যোগ করে জামাইরা মেলা থেকে চিড়া, মুড়ি, আকড়ি, মিষ্টি, জিলাপিসহ বিভিন্ন জিনিস কিনেন।’
মেলায় কথা হয় মো. আজিজ নামের ৮২ বছরের এক বৃদ্ধের সাথে। তিনি বলেন, ‘জন্মের পর থেকেই আমি এ মেলা দেখে আসছি। এটি জামাইমেলা হিসেবে অনেক পরিচিত। শ্বশুররা এ মেলা উপলেক্ষে জামাইদেরকে টাকা দেয়, আর জামাইরা এর সাথে কিছু টাকা যোগ করে মেলা থেকে বিভিন্ন কিছু কিনে। মেয়ের জামাইকে আমি দাওয়াত দিয়েছি, সেও মেলায় এসেছেন’।
রসুলপুর গ্রামের হামিদ মিয়া নামের ৪৫ বছরের এক জামাই বলেন, আমি প্রতিবছরই এই মেলায় আসি। মেলায় এসে আমার খুব ভালো লাগছে। প্রতিবছর শ্বশুর বাড়ির লোকজন আমাদেরকে দাওয়াত দেন।
কথা হয় সিরাজগঞ্জ থেকে আসা মানিক মিয়া নামের এক আকড়ি ব্যবসায়ীর সাথে। তিনি বলেন, ‘আমি এই মেলায় প্রায় ১৫ বছর ধরে আসছি। এখানে বিক্রি করে আমি লাভবান হই। এই মেলাটি জামাই মেলা হিসেবে পরিচিত। এবার প্রায় ৫০ মন আকড়ি নিয়ে এসেছি। বিক্রিও ভালো হয়েছে। গতবছর মেলায় ১ লাখ টাকার মতো বিক্রি হয়েছিল। আর এতে প্রায় ২৫ হাজার টাকার মতো লাভ হয়েছিল। তিনি বলেন, মেলার সময় বাড়িয়ে ৭দিন করলে আমাদের জন্য ভালো হতো।
অজিত দাশ নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, আমি বিভিন্ন স্থানে মেলায় যাই। তবে বিগত ১২ বছর ধরে রসুলপুরের জামাইমেলায় আসি। আমার সংসারের যাবতীয় খরচ এর উপর নিভর করে। মেলার কমিটির লোকজন আমাদের বিভিন্নভাবে সহযোগীতা করেছেন।
এ ব্যাপারে রসুলপুরের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নবপ্রজন্ম সাহিত্য গোষ্ঠীর সভাপতি মারুফ রহমান ও সাধারণ সম্পাদক মোবাইদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এই মেলা ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এই মেলাকে কেন্দ্র করে দারুণ একটা প্রাণচাঞ্চলের সৃষ্টি হয়। আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করি। এ কাজ করে আমরা প্রচুর আনন্দ পাই।’
এ ব্যাপারে মেলার আহবায়ক ফজলুল হক বলেন, ‘আমাদের এ মেলায় ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৩ শতাধিক দোকান বসেছে। এই মেলা টাঙ্গাইল জেলার মধ্য ঐতিহ্যবাহী মেলা। এই মেলায় শুরু হওয়ার আগেই গ্রামের জামাই এবং বউরা আসেন তাদের শ্বশুরবাড়িতে। তারা বিভিন্নভাবে মেলা উপভোগ করে থাকেন।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল