করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে নোয়াখালীর উপকূলীয় দুই উপজেলা হাতিয়া ও সুবর্ণচরে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। যদিও এ নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন কোনও আগ্রহ নেই। এদিকে জোয়ারের পানিতে পথঘাট ডুবে থাকায় নির্বাচন পেছানোর আবেদন করেছেন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার কয়েকজন চেয়ারম্যান প্রার্থী।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম খান সময়ের বলেন, ‘নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত আমাদের হাতে নেই। তবে হাতিয়ার ইয়াস পরবর্তী অবস্থা এবং জেলার সার্বিক করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি।’
জেলা সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা মো. রবিউল আলম জানান, আগামী ২১ জুন নোয়াখালীর উপকূলীয় দুই উপজেলা হাতিয়া ও সুবর্ণচরের ১৩ ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ইউনিয়নগুলো হলো- হাতিয়া উপজেলা নিঝুম দ্বীপ, জাহাজমারা, সোনাদিয়া, চর ইশ্বর, চরকিং, তমরুদ্দি, ও বুড়ির চর ইউনিয়ন। সুবর্ণচর উপজেলার চরবাটা, চরক্লার্ক, চরওয়াপদা, চর আমানউল্যাহ, পূর্বচরবাটা ও মোহাম্মদপুর ইউনিয়ন।
হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইমরান হোসেন জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ, জাহাজমারা, সোনাদিয়া, চর ইশ্বর, চরকিং, তমরুদ্দি, ও বুড়ির চর ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়। বেড়িবাঁধ নেই এমন অনেক এলাকায় এখনও জোয়ারের সময় পথঘাট পানির নিচে তলিয়ে যায়।
ইউএনও মো. ইমরান হোসেন বলেন, ‘এলাকার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন থেকে আমাদেরকে যে নির্দেশনা দেওয়া হবে আমরা তা বাস্তবায়ন করব। ’
নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেহরাজ উদ্দিন জানান, তার ইউনিযনের চারপাশে কোনও বেড়িবাঁধ না থাকায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ারের তোড়ে পথঘাট চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় নির্বাচন হলে ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার জন্য কেন্দ্রে যেতে পারবেন না। তাছাড়া যোগযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঠিকভাবে কাজ করতে পারবেন না। তিনি বলেন, ‘একজন প্রার্থী হিসেবে আমি এই নির্বাচন পেছানোর জোর দাবি জানাচ্ছি।’
সোনাদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার এলাকায় বেশিরভাগ সড়ক ইয়াসের প্রভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক ফুট উচ্চতায় জোয়ারের পানিতে বিধস্ত হয়েছে। এখনও অনেক মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আমরা প্রার্থী এবং ভোটাদের মধ্যে নির্বাচনের কোনও প্রস্তুতি নেই। বৃষ্টি এবং জোয়ারের কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় আমরা প্রার্থীরা অনেক এলাকায় প্রচারণা চালাতে পারছি না। এই সময়ে নির্বাচন হলে ভোটারা ভোট কেন্দ্রে যেতে পারবে না। এমনকি প্রশাসনের পক্ষেও নির্বাচনে যথাযথভাবে তদারকি করা সম্ভব হবে না। তাই আমরা একাধিক প্রার্থী এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন স্থগিত করে শুষ্ক মৌসুমে সবার অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে লিখিত দাবি জানিয়েছি।’
সোনাদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রতিদ্বন্ধি প্রার্থী ইয়াছিন আরাফাত বলেন, ‘হাতিয়ার প্রত্যেকটা ইউনিয়নে বেড়িবাঁধ ছিড়ে মানুষ পানিতে ভাসছে। লোনা পানিতে দুর্বিসহ অবস্থা। মানুষের কাজ নেই, খাবার নেই, গবাদী পশুর চারণভূমি পর্যন্ত ডুবে আছে। এই অবস্থার মধ্যে কিভাবে নির্বাচন হবে আমরা জানি না। আগে মানুষের জীবন-জীবিকা এরপর নির্বাচনের কথা চিন্তা করা দরকার ছিল। আমরা এই নির্বাচন স্থগিত করার জন্য দাবি জানিয়েছি।’
চর ঈশ্বর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল হালিম আজাদ বলেন, পূর্ণিমা এবং আমবস্যার জোয়ারে আমার এলাকার মানুষ যখন দিশেহারা তখন ভোট করার মতো অবস্থা আমরা প্রার্থী এবং ভোটার কারো মধ্যেই নেই। আমরা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরে লিখিত দিয়েছি। আমরা আশা করছি তারা বাস্তবসম্মত একটা সিদ্ধান্ত নেবেন। ’
তমরদ্দিন ইউনিয়নের তমরদ্দি গ্রামের বাসিন্দা মাহতাব উদ্দিন রতন বলেন, ‘হাতিয়ার মানুষ এখন নির্বাচন নিয়ে ভাবছে না। ভাবছে জোয়ারের পানি থেকে কিভাবে নিজেদেরকে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে।’
হাতিয়ার বাসিন্দা জেলা খেরমজুর ইউনিয়নের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এবং পূর্ণিমার জোয়ারের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠছে আজ থেকে আমবস্যার জোয়ার শুরু হচ্ছে। হাতিয়ার মানুষগুলো যে কি অবস্থার মধ্যে আছে তা নিজের চোখে না দেখছে কেউ বিশ্বাস করবে না। এই অবস্থার মধ্যে কিসের নির্বাচন। এটাতো একটা প্রহসন।’
সুশাসনের জন্যে প্রচারাভিযান সুপ্র জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল বলেন, করোনা সংক্রমণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত মানুষের কথা চিন্তা না করে ঠিক এই সময়েই নির্বাচন দিতে হবে, কিসের এতো বাধ্যবাধকতা আমি জানি না। স্থানীয় সরকারের অনেক নির্বাচনতো সীমানা বিরোধসহ মামলা কারণে বছরের পর বছর ঝুলে আছে। তাহলে বর্তমান পরিস্থিতিতে একটা পথ তো বের করা যেতো। আগে মানুষের নিরাপত্তা এরপর নির্বাচন হওয়াটাই বাঞ্ছনীয় নয়কি?’ আমরা আশা কবর নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে একটা বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নেবে।’
জেলা প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ৩৯৭ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৯৪ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এনিয়ে জেলায় মোট সনাক্তের সংখ্যা ৯ হাজার ১৫১ জন। এরমধ্যে হাতিয়া উপজেলায় ১৭১ জন ও সুবর্ণচর উপজেলায় ৪১৫ জন। জেলায় মোট মৃতের সংখ্যা ১২৪ জন।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার জানান, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত ৫ জুন থেকে ১১ জুন পর্যন্ত নোয়াখালী পৌরসভা এবং জেলা সদরের ছয় ইউনিয়নে বিশেষ লকডাউন ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন।
সিভিল সার্জন বলেন, যেকোনও সমাগমেই করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। হাতিয়া ও সুবর্ণচর উপজেলায় ইউনিয়ন নির্বাচনের বিষয়ে করোনা প্রতিরোধ কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। সামনে আরও আলোচনা হবে। এটি একটি জাতীয় বিষয় বিধায় এ বিষয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে যে সিদ্ধান্ত আসবে সেটাই চুড়ান্ত।’
সূবর্ণচর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শায়লা সুলতানা ঝুমা বলেন, ‘এর আগে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলে প্রচুর মানুষের শোডউন হয়। এ ধরনের শোডাউন বেশি হলে করোনা সংক্রমণ বাড়ার মারাত্মক ঝুঁকি থাকে। এখন তো সারাদেশেই করোনা পরিস্থিতির খারাপ অবস্থা। তাছাড়া আমাদের এখানে বর্তমানে ডায়রিয়া পরিস্থিতিও খুবই খারাপ।’
জেলা সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা মো. রবিউল আলম বলেন, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে আমাদেরকে নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আমরা সে মোতাবেক কাজ করছি। নির্বাচন পেছানোর বিষয়ে কয়েকজন চেয়ারম্যান প্রার্থীর লিখিত আবেদন পেয়েছি। তাদের আবেদনের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।’
বিডি প্রতিদিন/কালাম