পৌরাণিক কাহিনীর জেলা দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে ইতিহাস-ঐতিহ্যের বারপাইকের গড় আজ বিলীনের পথে। অবহেলা আর সংস্কারের অভাবে উঁচু একটি ঢিবি ছাড়া কিছুই নেই চিহ্ন। এই বারপাইকের তৎকালীন জায়গা দেখা যায় না। অনেক জমি বেদখলও হচ্ছে। তবে এটিকে সংস্কার করলে পর্যটকদের মনের খোরাক অনেকটাই মিটবে। তবে এই বারপাইকের গড়ের সাথে রানীগঞ্জের সড়ককে পাকাকরণ করতে হবে, এমনটাই বললেন স্থানীয়রা।
ঘোড়াঘাট উপজেলার সিংড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত ঘোড়াঘাট-রানীগঞ্জ সড়কের উপর বিরাহিমপুর কাচারী। আর কাচারীর পূর্ব ধারেই মইলা (মরা করতোয়া) নদী বেষ্টিত ত্রিভুজাকৃতি স্থলভাগটিই ‘বারপাইকের গড়’। মৌজার নামও বারপাইকের গড়, মৌজার মোট জমি ৩৯৩.৬০ একর। ঘোড়াঘাট দুর্গ থেকে এ স্থানের দূরত্ব উত্তর-পশ্চিমে প্রায় ১০ কিলোমিটার।
এখানে প্রাচীনকালে একটি দুর্গ ছিল তার প্রমাণ মিলে ইতিহাসে। গড়ের জমির পরিমাণ ৭৬.২৭ একর। নদীর স্রোত ঘেঁষে গড়ের চারদিকে ৪০ ফুট প্রশস্ত ও ৮/১০ ফুট উঁচু মাটির প্রাচীর ছিল। বর্তমানে মাটির প্রাচীরের উচ্চতা আগের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে। গড়ের চারদিকে যে নদী বা পরিখা আছে। তার প্রশস্ততা পূর্ব দিকে ৫০ ফুট এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে ১২০ ফুট, গভীরতার কারণে খরা মৌসুমেও পানি থাকে। স্থানটি বড় গড় ও ছোট গড় দুটি অংশে এখন বিভক্ত। গড়ের ধারে প্রাচীন সমাধির পাশেই আছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একটি সাইনবোর্ড।
বারপাইকের গড়টি কোন আমলে সৃষ্টি তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে গৌড়ের সুলতান রুকনউদ্দিন বরবক শাহ’র আমলে (১৪৫৯-১৪৭৬ খ্রি.) তার সেনাপতি শাহ ইসমাইল গাজী ১২ জন পাইকস নিয়ে এই দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। ভাগিনা মুহাম্মাদ শাহের উপর দুর্গ রক্ষার ভার দিয়ে গাজী উত্তরে চতরাহাটের কাছে জলমোকাম নামক স্থানে চলে যান। ১২ জন পাইক থাকার কারণে দুর্গটির নাম বারপাইকের গড় হয়। তার আগে এটি কোন নামে পরিচিত ছিল, জানা যায় না।
ধারণা করা হয়, এই গড়টি পাঠান আমলের আগে নির্মিত হয়েছিল কামরূপ কামতা রাজ্যের আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে। রাজা নীলাম্বরের সময়ে দুর্গটি নির্মিত বলে কোচবিহারের ইতিহাসে ইঙ্গিত রয়েছে। কিন্তু গড়টি ওই রাজার আমলেরও আগের বলে অনুমেয়। যাইহোক, মুসলিম শাসন আমলে দুর্গটি ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারাতে থাকে। এর পরিবর্তে ঘোড়াঘাট দুর্গ প্রাধান্য লাভ করে। ক্রমে স্থানটি জঙ্গল ও দুর্গম হয়ে পড়ে। পাকিস্তান আমলে স্থানীয় সাঁওতাল ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরা জঙ্গল পরিষ্কার করে আবাদযোগ্য করে তোলে স্থানটি। বিরাহিমপুর থেকে গড়ে পারাপারের জন্য একটি বাঁশের সাঁকো আছে।
দিনাজপুর জেলার গেজেটীয়ার (১৯৯১ সালে মুদ্রিত) থেকে আরো জানা যায়, প্রাচীনকালে গড়ের ভেতরে একটি অট্টালিকা ছিল, ব্রিটিশ আমলেও তার সামান্য অস্তিত্ব ছিল। এখন সামান্য উঁচু মাটির ঢিবি দৃষ্টিগোচর হয়। সরেজমিনে বাস্তব অবস্থা দৃষ্টে বলা যায়, অতীতে এটা সুরক্ষিত দুর্গ ছিল। গড়ের পূর্ব ধারে একজন মুসলমান পীরের মাজার আছে। সেটি দেওয়ান পীরের মাজার বা অচীন পীরের মাজার বলে স্থানীয়রা জানেন। তবে তিনি কোথাকার লোক এবং কী তার পরিচয় সে সম্পর্কে কিছু জানা যায় নাই। স্থানীয় মুসলমানসহ অন্য ধর্মের লোকও এই মাজারকে যথেষ্ট সম্মান করেন। এই গড়কে নিয়ে নানান জনশ্রুতি স্থানীয়ভাবে প্রচার রয়েছে।
বারপাইকের গড় দরগা ও বাজার পরিচালনা কমিটির সহ-সম্পাদক মোহাম্মদ সুলতান কবির জানান, বারপাইকের গড়ের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে এই কমিটি। তবে এই গড়ের সাথে সংযুক্ত রাস্তাগুলো পাকাকরণ করা হলে ইতিহাস-ঐতিহ্যের এই বারপাইকের গড় দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকদের সংখ্যা বাড়বে।
বিডি প্রতিদিন/এমআই