২৫ মে, ২০২৪ ১৭:৫২

বগুড়ায় জামাইবরণ মেলা শুরু

আবদুর রহমান টুলু ,বগুড়া

বগুড়ায় জামাইবরণ মেলা শুরু

৪৬৮ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় আজ রবিবার থেকে শুরু হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী কেল্লাপোশী মেলা। তিথি অনুযায়ী প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় রবিবার থেকে উপজেলা সদরের অদূরে কেল্লাপোশী নামকস্থানে এই মেলার আয়োজন করা হয়। স্থানীয়দের ভাষায়, যাকে ‘জামাইবরণ’ মেলাও বলা হয়ে থাকে।

মেলা বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য। এই মেলাকে ঘিরে এবার গ্রামে গ্রামে চলছে রকমারি আয়োজন। আনন্দ উল্লাস আর উৎসবে মেতে ওঠার অপেক্ষায় লাখো মানুষ। তারা প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকেই নানা ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। মেলা উপলক্ষ্যে সবাই নিজ নিজ আত্মীয়স্বজনকে বাড়িতে দাওয়াত দিচ্ছেন। নিমন্ত্রণে নতুন-পুরনো জামাই-বউ রয়েছেন তালিকার শীর্ষে। শ্বশুরালয়ে আসা জামাইরা থাকেন ভিন্ন মুডে। কারণ মেলা করতে তাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় মোটা অঙ্কের সেলামি। সেই সেলামি আর নিজের গচ্ছিত টাকা দিয়ে জামাইয়েরা মেলা থেকে খাসি কিনে শ্বশুর বাড়িতে আনেন। এমনকি বড় বড় মাটির পাতিল ভর্তি করে মিষ্টান্ন সামগ্রী, সবচেয়ে বড় মাছ, মহিষের মাংস, রকমারি খেলনা কেনেন। এছাড়া শ্যালক-শ্যালিকাদের নিয়ে মেলা ঘুরে ঘুরে দেখেন। আর মেলা থেকে রকমারি মসলা, তুলা, কাঠের সামগ্রী, বড় বড় ঝুড়ি, চুন সারা বছরের জন্য কিনে রাখেন গ্রামের সাধারণ মানুষ।
 
১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই মেলা হয়ে আসছে বলে কথিত আছে। বৈরাগ নগরের বাদশা সেকেন্দারের একজন ঔরশজাত পুত্র এবং একজন দত্তক পুত্র ছিলেন। ঔরশজাত পুত্রের নাম গাজী মিয়া ও দত্তক পুত্রের নাম কালু মিয়া। গাজী মিয়া দেখতে খুবই সুদর্শন ছিলেন। তারা রাজ্যের মায়া ত্যাগ করে ফকির সন্যাসীর বেশ ধারণ করে ঘুরতে ঘুরতে ব্রাহ্মণ নগরে আসেন। সেখানে ব্রাহ্মণ রাজমুকুটের একমাত্র কন্যা চম্পা গাজীকে দেখে মুগ্ধ হন। এক পর্যায়ে তারা দু’জন দু’জনকে ভালবেসে ফেলেন। পালিত ভাই কালু মিয়া বিষয়টি জানতে পেরে গাজীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মুকুট রাজার নিকট যান। মুকুট রাজা ফকির বেশী যুবকের এরূপ স্পর্ধা দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে বন্দী করেন। এতে গাজী মিয়া দারুণ আঘাত পান। তিনি মুকুট রাজার নিকট থেকে ভাই কালু মিয়াকে উদ্ধারের জন্য কেল্লাপোশী নামক স্থানে একটি দূর্গ নির্মাণ করেন। পরে রাজার সাথে যুদ্ধ করে ভাইকে উদ্ধার এবং তার কন্যাকে বিয়ে করেন। আর ওই দিনটি ছিল জ্যৈষ্ঠ মাসের দ্বিতীয় রবিবার। ওই সময় গাজীর বিয়ে উপলক্ষে কেল্লাপোশী দূর্গে নিশান উড়িয়ে তিন দিনব্যাপী আনন্দ উৎসব চলে এবং সেখানে মাজার গড়ে তোলা হয়েছে। মেলা চলাকালে সেখানে ভক্তরা আসর বসায়। সেই সূত্র ধরেই প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় রবিবার থেকে তিন দিনব্যাপী মেলা বসে। আর এই মেলা উপলক্ষে এলাকাবাসী নতুন জামাইকে ঘরে এনে আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠেন। এছাড়া নিকট আত্মীয়স্বজনের পদচারনায় মুখরিত হয়ে ওঠে মেলা এলাকা।
 
এদিকে মেলা শুরুর প্রায় সপ্তাহখানেক আগ থেকে গ্রামে গ্রামে চলে মাদার খেলা (লাঠি খেলা)। একটি বড় বাঁশকে লাল কাপড়ে মুড়িয়ে ও নানা রংয়ে সাজিয়ে এবং সেটির বিভিন্ন স্থানে চুল লাগিয়ে ১৫ থেকে ২০ জনের একটি দল বেরিয়ে পড়ে। ঢাকঢোল, গান-বাজনার নানান সরঞ্জামাদি আর লাঠি নিয়ে তারা গ্রাম-গঞ্জ থেকে শুরু করে শহরে খেলা দেখায়। মেলা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত চলে ওই মাদার খেলা। জ্যৈষ্ঠের দ্বিতীয় রবিবার দলটি মেলা এলাকায় অবস্থিত মাজার প্রাঙ্গনে গিয়ে তা শেষ করে। এবছরও মেলাকে কেন্দ্র করে বিভিন্নস্থানে মাদার খেলা চলছে। আর ঐতিহ্যবাহী এই মেলাকে সামনে রেখে এলাকায় সাজ সাজ রব পড়ে গেছে।

উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত কেল্লাপোশী নামক স্থানে তিন দিনব্যাপী ওই মেলায় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে কেনা কাটার ধুম। দূর-দূরান্ত থেকে আসা বিক্রেতারা এখানে দোকান সাজিয়ে জাঁকিয়ে বসেন। এই মেলার প্রধান আকর্ষণ হলো বিভিন্ন ধরনের কাঠের আসবাবপত্র, মিষ্টি-ফল, নানা জাতের বড় বড় মাছ, কুটির শিল্প সামগ্রী, মহিষ ও খাসির মাংস, রকমারি মসলা। তিন দিন মেলা চলার নিয়ম থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা ছয়-সাত দিনে গড়ায়। এই মেলায় কোটি টাকার দ্রব্যাদি কেনাবেচা হয়।
 
শেরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রেজাউল করিম রেজা জানান,  ঐতিহ্যবাহী এই মেলা করতে কমিটির পক্ষ থেকে ৩ দিনের অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। মেলায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ইতোমধ্যেই তারা কাজ শুরু করেছেন। তবে মেলায় কোনো ধরনের অশ্লীল নাচ-গান ও জুয়া খেলতে দেওয়া হবে না।

 

বিডি প্রতিদিন/নাজমুল

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর