শুক্রবার, ৬ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

সূচির বিড়াল টুনি

জয়শ্রী দাস

সূচির বিড়াল টুনি

সূচির বয়স দশ। তার কথার মধ্যে উচ্ছলতা আছে যা অন্যকে আকৃষ্ট করে। তার বাবা সরকারি কর্মকর্তা এবং মা মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষিকা। পরিবারে বাবা-মা, সূচি, বুয়া আর আছে একটি ছোট্ট মিষ্টি চেহারার বিড়াল। যার নাম টুনি। তারা সুখী পরিবার। সূচি আর টুনি দুজনেই তাদের মা মহসিনা খানমের কোলঘেঁসে থাকতে ভীষণ পছন্দ করে। সূচি তার মায়ের স্কুলেই পড়ে। সূচি আর তার মা যখন স্কুলে যায় তখন টুনির মন খারাপ হয় না কারণ তাদের বাসার বুয়া মাজেদা খালা টুনিকে খুব আদর করে। মাজেদা সূচির জন্মের পর থেকেই এ বাড়িতে আছে। সেদিন স্কুলে টিফিন পিরিয়ডে হঠাৎ মাজেদা খালা সূচিদের স্কুলে গেল টুনিকে নিয়ে। টুনিকে দেখে সূচির কাছের বন্ধুরা মহাখুশি। কেউ তাকে চুমু দেয়। আবার কেউ তাকে বুকে পিষে একাকার। অতিরিক্ত আদরে টুনির মুখ থেকে ম্যাও ম্যাও ছাড়া কোন শব্দই বের হলো না।

সূচি যা বলে বাবা মা তাই শুনেন। তবে সূচি ভীষণ ভালো মেয়ে। সে অন্যায়ভাবে কোনো আবদার করে না। সেদিন শীতের সকালে সূচি যখন সাদা আর বুকের ওপর লাল বিড়াল আঁকা সোয়েটার পরলো, তখন সে মায়ের কাছে বায়না ধরে বলল, ‘মা তুমি টুনির জন্য এমন একটা জামা বানিয়ে দাও না। ওর শীত করছে।’

মা শান্ত ও সুশ্রী একজন মমতাময়ী মানুষ। তিনি স্মিত হেসে বললেন, ‘এক্ষুনি বানিয়ে দিচ্ছি।’

মা সেলাই মেশিন নিয়ে বসলেন। টুনি যেনো সবই বোঝে, আনন্দে সে তখন লাফাচ্ছে। বেশি বেশি করে ম্যাও ম্যাও করছে। সূচি টুনিকে কোলে নিয়ে মায়ের পাশে বসে পড়লো। মা টুনির শরীরের মাপ নিয়ে তার জন্য সাদা আর লালের মিশেল দুটো মোটা কাপড়ের জামা তৈরি করে দিলেন।

জামা গায়ে দিয়ে টুনির মনে যেন আনন্দের বান ডাকলো। সে লাফ দিয়ে সূচির বিছানায় উঠল আবার নেমে পড়ল। সূচি খুব আবেগপ্রবণ শিশু। টুনির আনন্দ দেখে সূচি দিশাহারা হয়ে গেল। চোখ ছলছল করে মায়ের কাছে গিয়ে বলল, ‘মা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।’

মা সূচিকে জড়িয়ে ধরে গালে কপালে চুমু দিয়ে বললেন, ‘আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি।’

ঋতুর পরিবর্তনে এখন আষাঢ় মাস। গাছে গাছে কদম ফুল ফুটেছে। সূচির বাবা তার মাকে অনেক ভালোবাসেন। তিনি যখন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরছিলেন তখন সূচির মায়ের জন্য কদম ফুল কিনে নিয়ে এলেন। সূচি কদমফুল দেখে খুশি হলো। সে তিনটে কদমফুল নিয়ে মালা বানিয়ে টুনির গলায় পরিয়ে দিল। মা, সূচি আর টুনিকে নিয়ে অনেক ছবি তুললেন বাবা।

‘সুখ’ নামের শব্দটা জলের ধারার মতো গড়িয়ে গড়িয়ে সমুদ্র পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারে না। সে কোথাও থমকে দাঁড়ায়। সেখান থেকে আর তাকে টেনে তোলা যায় না। ঠিক এমনই একটা ঘটনা ঘটল সূচির জীবনে। তার মা মহসিনা খানমের শরীর খারাপ করলো তাকে নিয়ে যাওয়া হলো ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানালেন, ‘সূচির মায়ের কিডনির সমস্যা।’

মায়ের চিকিৎসা শুরু হলো। সূচির বাবা মনেপ্রাণে লড়ছেন। যে করেই হোক তার প্রিয় মানুষটাকে বাঁচাতে হবে। প্রকৃতিতে ঝরছে বর্ষার জলধারা, আর তার হৃদয়ের মাঝে ঝরছে কান্নার ধারা। টুনি যেন বিড়াল নয়, সে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। সে সারা দিন মায়ের পায়ের কাছে বসে থাকে। মায়ের শরীরটা বেশি খারাপ। মা এখন স্কুলে পড়াতে যেতে পারেন না। সারা দিন শুয়ে থাকেন।

সূচি স্কুলে গেলে যদি মায়ের কিছু প্রয়োজন হয় তাহলে মা বুয়াকে ডাকেন। বুয়া যদি রান্না ঘরে থাকে শুনতে না পায়, তখন টুনি দৌড়ে গিয়ে বুয়ার সামনে ম্যাও ম্যাও করে ডাকতে থাকে। তখনই বুয়া বোঝে এবং দৌড়ে আসে।

শ্রাবণ মাস বাইরে অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। সূচিকে আজ কিছুতেই স্কুলে নেওয়া গেল না। বৃষ্টির জলে সে আর টুনি দুজন মিলে ¯œান করল। এরপর দুজন মিলে মায়ের কোলের কাছে শুয়ে রইল। মায়ের শরীরটা খুব খারাপ, তিনি খুব ছটফট করছেন। দুপুর হয়ে গেল। বাইরের কালো মেঘ যেন সূচিদের ঘরটা অন্ধকার ছেয়ে ফেলল। সূচির আর টুনির দুজনার খুব খিদে পেয়েছে। টুনি ম্যাও ম্যাও করে আর সূচি মা মা করে ডাকছে। মা আর কোনো সাড়া দিচ্ছেন না। তাদের দু’জনার চিৎকারে বুয়া দৌড়ে এলো। মায়ের প্রাণহীন দেহটা স্পর্শ করে, বুয়া বুঝে গেল মা আর বেঁচে নেই। মা হারা সূচিকে আগলে রাখে টুনি। সারাদিন ব্যস্ত রাখে অনেক রকম কাজে। সূচির কোল ঘেঁষে ঘুমায় টুনি। মায়ের অভাব যেন সে একাই পূরণ করার দায়িত্ব নেয়। সূচি রং পেনসিল দিয়ে মায়ের ছবি আঁকে। অবাক হয়ে সূচি লক্ষ্য করে মায়ের ছবি দেখে টুনি কাঁদছে। তার চোখে জল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর