চোত-বোশেখ মাসে ভোর খুব দ্রুত হয় বলেই হয়তো সকাল ৯টা কিংবা ১০টায় মনে হয় ভরদুপুর। পাসপোর্ট অফিসের সামনে রেলগাড়ি-সদৃশ লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। সূর্যের প্রবল চোখ রাঙানিতে ঘেমে- নেয়ে সবারই প্রায় বিশ্রী অবস্থা। লাইনটি এগোচ্ছিল পিঁপড়ের গতিতে। হঠাৎ এক দমকা বাতাস এসে লাগল আমার মুখাবয়বে; সে বাতাসে মিশে ছিল উৎকট বিশ্রী এক দুর্গন্ধ। আমার সামনে যে লোকটি দাঁড়িয়ে আছে দুর্গন্ধটা আসলে আসছে তার কাছ থেকে। ঘামের গন্ধ। অথচ লোকটির পোশাক-পরিচ্ছদ ধোপদুরস্ত ও বেশ ফিটফাট কিন্তু ভিতরে সদরঘাটের আবর্জনার দুর্গন্ধের ভাগাড়। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। লোকটি পোশাক-আশাক, জামা-জুতোয় এত টাকা খরচ না করে যদি অল্প কিছু টাকা অডিলোকন, বডিস্প্রে কিংবা নিদেনপক্ষে স্বল্পমূল্যের ট্যালকম পাউডারের পেছনে খরচ করত তাহলে নিশ্চয়ই আশপাশের মানুষগুলোকে এ ‘দুর্গন্ধ থেরাপি’ পেতে হতো না। এই মানুষটি কিন্তু আমাদের সমাজের বিচ্ছিন্ন কেউ নন। সচেতন ও পরিচ্ছন্নতার এ যুগেও অনেক মানুষই আছেন যারা নিজের স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে বেশ উদাসীন। মেয়েদের মধ্যেও অনেকে আছেন যারা তাদের স্বর্ণালংকার, জামা-জুতো, রূপলাবণ্য পরিচর্যায় অজস্র অর্থকরী খরচ করেন বটে কিন্তু নিজেকে সুবাসিত ও সুগন্ধময় করার বিষয়ে একেবারেই মনোযোগহীন। এ বিষয়ে একটি কাহিনি মনে পড়ে গেল। দিগি¦জয়ী বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ৩৩৪ খ্রিস্টপূর্বে যখন পারস্য জয় করেছিলেন সে সময় পারস্যের সম্রাট দারিউসের রাজপ্রাসাদটি ছিল সত্যিই দেখার মতো। এত সুন্দর জাঁকালো ও জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদ বোধকরি সে সময় সমস্ত বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি ছিল না। আলেকজান্ডারের সৈন্য-সামন্ত ও পারিষদরা সবাই মিলে যখন ঘুরেফিরে প্রাসাদের সৌন্দর্য মুগ্ধনয়নে ও অবাক বিস্ময়ে দেখছিলেন তখন আলেকজান্ডার তাঁর অন্যতম সেনাপতি পারমিনিয়নকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘দেখেছো পারমিনিয়ন! প্রাসাদের ভিতর কী সুন্দর গন্ধ। স্বর্গীয় এ সুগন্ধই বলে দেয় সমস্ত ভূভাগে এমন প্রাসাদ আর দ্বিতীয়টি নেই।’ আপনারা অনেকেই হয়তো ফ্রান্সের বিখ্যাত ভার্সাই প্রাসাদের নাম শুনে থাকবেন। এ প্রাসাদটির পুরো নাম শাঁতো দু ভার্সাই। ১৬৭৭ খ্রিস্টাব্দে প্রাসাদের নির্মাণকাজ পূর্ণতা পায়। বিশ্ববিখ্যাত সেই রাজকীয় প্রাসাদটি সুগন্ধময় করে তুলতে রাজা চতুর্দশ লুই প্রাসাদের ভিতর বিশালাকৃতির সব টবের ভিতর হাজারখানেক কমলা গাছ স্থাপন করেছিলেন; যাতে কমলা ফুলের সুবাসে মোহিত হয়ে ওঠে সমস্ত রাজপ্রাসাদ। সে বিষয়ে বিস্তারিত পরে বলছি। এখন আলোচনা করা যাক আমরা কেন সুগন্ধি ব্যবহার করব। এর কিন্তু বেশ কয়েকটি দিক রয়েছে। প্রথমত একটি ভালো সুগন্ধি একজন মানুষকে সুবাসিত ও স্নিগ্ধময় করে তোলে। সেই সঙ্গে মানুষটিকে করে তোলে প্রত্যয়ী ও আত্মবিশ্বাসী। বর্তমান বিশ্বে সুগন্ধি শিল্পের রয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার বাজার। প্রথম দিকে এ বাজারের সিংহভাগ পর্যায়ক্রমে ফ্রান্স, ইতালি, ইংল্যান্ড ও জার্মানির হাতে থাকলেও আমার ধারণা খুব দ্রুতই এ বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে আরব আমিরাত এবং সর্বোপরি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। যেখানে উন্নত বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় শতকরা ৮০-৯০ ভাগ মানুষ সুগন্ধি ব্যবহার করে সেখানে বাংলাদেশে শতকরা ১০-১৫ শতাংশ মানুষ সুগন্ধি ব্যবহার করে কি না সন্দেহ আছে। অথচ আমরা যারা ইসলাম ধর্মের অনুসারী সেই ধর্ম অনুযায়ী সুগন্ধি ব্যবহার কিন্তু সুন্নত অর্থাৎ আমাদের নবীজিও সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। মেশক (কস্তুরী) ও আম্বর ছিল তাঁর প্রিয় সুগন্ধি। সুগন্ধি কিন্তু মানুষের মনে প্রশান্তি আনে সেই সঙ্গে মেজাজমর্জিও ভালো রাখতে সহায়তা করে। প্রথমেই বলে রাখা ভালো, সুগন্ধির এ জগৎটা বিশাল। এখানে যেমন রয়েছে হাজার হাজার ব্র্যান্ড তেমনি রয়েছে পারফিউম তৈরির অসংখ্য উপকরণ। এ উপকরণগুলো সংগ্রহ করা হয় প্রাকৃতিক ফুল, ফল ও বনজ সম্পদ, বৃক্ষ ও লতাপাতা থেকে। সেই সঙ্গে বর্তমানে অজস্র উপাদান তৈরি হয় ল্যাবে। কামরাঙা, পেঁপে, আনারসের এসেন্স থেকে শুরু করে তিমি মাছের বমি, তামাকের পাতা, চামড়া, সিভেট (গন্ধগোকুল প্রাণী থেকে প্রাপ্ত উপাদান) সবকিছুই ব্যবহার করা হয় এ সুগন্ধি তৈরিতে। এখন জানা যাক সুগন্ধি কীভাবে মানুষের মেজাজমর্জি উৎফুল্ল করে তোলে। ইউটিউবে সার্চ করলে আপনারা সহজেই পেয়ে যাবেন একজন সুগন্ধি আলোচক আছেন যার নাম মারিয়া। তো হয়েছে কি, সেই মারিয়া একদিন ‘টেরি মুগলার’ ব্র্যান্ডের একটি পারফিউম কিনে এনেছেন পারফিউম শপ থেকে; সেটার নাম ছিল ‘অ্যানজেল মিউজ’, বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘দেবদূতকে যা জাদু করতে পারে’। পারফিউমটি সত্যি খুব সুন্দর। এটা আমার নিজের সংগ্রহেও আছে একটা। মারিয়ার কিন্তু আদৌ ভালো লাগল না পারফিউমটা। তিনি দোকানে ওটা যথারীতি ফেরত দিতে গেলেন। দোকানি জানালেন প্রসাধনসামগ্রী একবার ব্যবহারের পর আর ফেরত নেওয়া হয় না। এ কারণে বাড়ি ফিরে রাগ ও ক্ষোভে পারফিউমটা তিনি ইচ্ছামতো নিজের শরীরে স্প্রে করলেন। মারিয়া দীর্ঘদিন ধরে ইনসোমেনিয়া অর্থাৎ অনিদ্রায় ভুগছিলেন কিন্তু কি আশ্চর্য সে রাতে তার দারুণ একটা ঘুম হলো। মারিয়া তো রীতিমতো অবাক, রাতে তিনি ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না অথচ আজ এমন মরা ঘুম হলো তার! পারফিউমের মধ্যে কি এমন কিছু আছে যা তাকে ঘুমাতে সাহায্য করেছে। পরদিন আবার তিনি ওই একই পারফিউম ব্যবহার করলেন শরীরে। অবাক কাণ্ড, সেদিনও তার ভালো ঘুম হলো। তিনি অনুসন্ধান শুরু করলেন এমন কী উপাদান আছে যা তাকে ঘুমাতে সাহায্য করছে। অবশেষে দেখা গেল অনেক উপাদানের সঙ্গে সেই পারফিউমটায় আছে ‘ভেটিভার’। ভেটিভারের কোনো বাংলা নাম নেই কিন্তু এটাকে হিন্দি ও উর্দুতে বলে ‘খাস’। এ ভেটিভার অথচ খাসের আদিনিবাস কিন্তু ভারত। ভেটিভার দেখতে বড় বড় ঝাড়জাতীয় লম্বা লম্বা ঘাসের মতো। এর শেকড় শুকিয়ে চূর্র্ণ করে এখনো ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শরবত করে খায়। একবার উত্তর প্রদেশের কানপুরে আমি নিজেও খাসের শরবত খেয়েছি। খাস এমন একটি জিনিস যা গরমে প্রশান্তি দেয়। শরীর-মন দুটোই জুড়োয়। আমি আগেই বলেছি ভারতে সেই প্রাচীনকাল থেকে ভেটিভার ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সাধারণত জমিদার ও উচ্চবিত্তরা তাদের বাড়ি কিংবা প্রাসাদের টানা বারান্দা কিংবা অলিন্দে সাদা কাপড় টাঙিয়ে সেখানে খাছের পানি ঢেলে দিতেন। এর ফলে তাদের বিশ্রাম ও বিশ্রম্ভালাপে সুবিধা হতো। বহমান বাতাসে খাসের সুগন্ধি তাদের মনপ্রাণ মোহিত করে তুলত। রাজা হর্ষবর্ধন ৬০৬ থেকে ৬৪৮ সাল পর্যন্ত উত্তর ভারত শাসন করেছিলেন। সেই হর্ষবর্ধন যখন দেখলেন চারদিকে খাসের ব্যবহারে রমরমা চলছে তখন ইতিহাসে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি এটির ওপর কর আরোপ করেছিলেন। এটা বলে রাখা ভালো যে, এ সুগন্ধিগুলোর একেকটি উপাদান ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ওপর ভিন্ন ভিন্নভাবে কাজ করে। মারিয়ার শরীরে হয়তো ভেটিভার বেশি কার্যকর হয়েছে। ঠিক তেমনি বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে ল্যাভেন্ডারও বেশ ভালো কাজ করে। ল্যাভেন্ডার মাথা ঠান্ডা করে মানুষকে প্রশান্তি দেয় এবং ঘুমে এটা ভীষণভাবে কার্যকর।যে কথা বলছিলাম। সেই প্রাচীনকালেই গ্রিক ও রোমানরা ল্যাভেন্ডারের মাহাত্ম্য সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তারা জানতেন উষ্ণ মস্তিষ্ক শীতল করতে ও নিদ্রায় ল্যাভেন্ডার বেশ উপাদেয়। এজন্যই বোধকরি ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে যখন আধুনিক পারফিউমারির সূচনা ঘটে তখন মেয়েদের সব পারফিউমেই ল্যাভেন্ডার থাকত। পুরুষশাসিত সমাজ সব সময়ই মনে করে পুরুষের চেয়ে মেয়েদের মস্তিষ্কই বেশি উত্তপ্ত! ল্যাভেন্ডার খুব দামি একটি ফুল। প্রাচীন রোমে ১ পাউন্ড (প্রায় আধা সের) ল্যাভেন্ডার ১০০ ডেনারি (রোমের মুদ্রার নাম) দরে বিক্রি হতো। ১০০ ডেনারি সে যুগে একজন শ্রমিকের এক মাসের বেতন। অন্যদিকে ১০০ ডেনারি দিয়ে সে সময় কমপক্ষে ৫০বার চুল কাটানো যেত। ইংল্যান্ডের রানি প্রথম এলিজাবেথও ল্যাভেন্ডারের ভীষণ ভক্ত ছিলেন। তিনি নানাবিধ রোগে আক্রান্ত ছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল অনিদ্রা। সেজন্য ল্যাভেন্ডার সুগন্ধি তিনি রীতিমতো ব্যবহার করতেন। সকালে রুটির সঙ্গে খেতেন ল্যাভেন্ডার জেলি। সকাল-বিকাল পান করতেন ল্যাভেন্ডার চা।
এবার তাহলে আলোচনা করা যাক টয়লেটের পানি কীভাবে সুগন্ধি হলো। প্রসঙ্গক্রমেই বলতে হয়, শক্তির দিক থেকে বিবেচনা করলে একটি সুগন্ধিকে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝানো যেতে পারে। যেমন আমরা মাথাব্যথায় নাপা ট্যাবলেট খাই। মাথা একটু বেশি ব্যথা হলে নাপা এক্সট্রা খাই। আরও বেশি ব্যথা হলে নাপা এক্সট্রা এক্সট্রেন্ড খাই। ঠিক তেমনি এসেনশিয়াল অয়েলের ওপর নির্ভর করে একটি সুগন্ধি কতটা শক্তিশালী। যেমন সবচেয়ে কম শক্তিশালী পারফিউমকে বলে কোলন। জার্মানির কোলন শহরে ১৭০৯ সালে এ সুগন্ধির জন্ম বলে একে কোলন বলে। এ-জাতীয় পারফিউমগুলোয় এসেনশিয়াল অয়েলের পরিমাণ ৫ শতাংশ হয়ে থাকে। বিকাল বা সন্ধ্যার দিকে দু-চার ঘণ্টা ব্যবহারের জন্য এ ধরনের সুগন্ধি বেশি উপযোগী। দ্বিতীয় ধাপের পারফিউম টয়লেটি। এ ধরনের পারফিউমে এসেনশিয়াল অয়েলের পরিমাণ থাকে ৭ থেকে ১০ শতাংশ। এর পরের ধাপ ইউ ডি পারফিউম। এ ধরনের সুগন্ধিগুলোয় এসেনশিয়াল অয়েলের পরিমাণ ১৫ শতাংশ। এর পরের ধাপ পারফাম। এটাতে থাকে ২০ শতাংশ। এরপর এলিক্সজার। এটাতে পাওয়া যায় ২৫ শতাংশ এসেনশিয়াল অয়েল। একেবারে শেষ ধাপকে বলা হয় এক্সটাইট। এ ধরনের সুগন্ধিতে থাকে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ অয়েল। পারফিউমের দামও কিন্তু নির্ধারিত হয় কোন পারফিউমে কতটুকু এসেনশিয়াল অয়েল রয়েছে তার ওপর।
সে যা হোক, ১৩৭০ খ্রিস্টাব্দে হাঙ্গেরির রানি এলিজাবেথের জন্য ইউরোপে ‘হাঙ্গেরিয়ান ওয়াটার’ নামে সর্বপ্রথম অ্যালকোহলভিত্তিক পারফিউম তৈরি করা হয়। ইতিহাসে এ পারফিউমটাই প্রথম ‘ইউ ডি টয়লেট’ হিসেবে নাম লিখিয়েছে। ১৯৫০ সালের আগ পর্যন্ত সমস্ত পারফিউমই ছিল ইউ ডি টয়লেট। পরে ব্যবসার কৌশল হিসেবে এর বিভিন্ন শ্রেণিবিভাজন হয়েছে। তো এ টয়লেট শব্দটা সুগন্ধির সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হলো? আসলে টয়লেটি একটি ফরাসি শব্দ যার অর্থ ছোট্ট টুকরো কাপড়। তবে এর আরেকটি অর্থ হচ্ছে প্রসাধন করা। অর্থাৎ দাড়ি কামিয়ে মুখাবয়বে সুগন্ধি পানি ছিটানো বা নিজেকে সুন্দর পরিপাটি করা বোঝাতেও মধ্যযুগে ফরাসি দেশে টয়লেটি শব্দটি ব্যবহৃত হতো। ফরাসি এ Toilette শব্দ থেকেই ইংরেজিতে Toilet শব্দের ব্যুৎপত্তি হয়েছে। বাংলায় যার অর্থ শৌচাগার। তবে ফরাসিরা নিজেকে সুন্দর অর্থাৎ প্রসাধন করার জন্য কেন এ শব্দটিই বেছে নিয়েছেন? প্রাচীন যুগে রোমে নিত্যদিনের পোশাক-পরিচ্ছদ ধোয়া ও দাঁত মাজার জন্য ইউরিন অর্থাৎ মানুষের মূত্র ব্যবহার করা হতো।সেটাই ছিল সে যুগের বাস্তবতা। শুধু সাধারণ মানুষই নয়, সম্রাট ও তার পরিবারের সদস্যরাও প্রস্রাব ব্যবহার করতেন কাপড় ধুতে ও দাঁত পরিষ্কার করতে। সে যুগে উচ্চশ্রেণির মানুষের মধ্যে ধারণা ছিল, পর্তুগালের মূত্রই নাকি সবচেয়ে উৎকৃষ্ট প্রস্রাব। এজন্য ধনিক শ্রেণি বহু টাকা খরচ করে পর্তুগাল থেকে উৎকৃষ্ট মূত্র আমদানি করে আনতেন। ইতিহাসে রোমান সম্রাট নিরো (৩৭-৬৮ খ্রিস্টাব্দ) সর্বপ্রথম প্রস্রাবের ওপর কর আরোপ করেন। পরেত তা বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে সম্রাট ভেসপেসিয়ান পুনরায় মূত্রকর আরোপ করে ব্যাপক রাজস্ব আয় করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ভেসপেসিয়ানের ছেলে টাইটাস প্রস্রাবের ওপর কর আরোপের বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করলে সম্রাট ভেসপেসিয়ান একটি ধাতব মুদ্রা ছেলের নাকের সামনে নিয়ে প্রশ্ন করলেন, দেখো তো বৎস এ মুদ্রাটি থেকে কি তুমি প্রস্রাবের গন্ধ পাচ্ছো? মনে রেখো, টাকার গন্ধ সব সময়ই সুন্দর। প্রস্রাব দিয়ে কিন্তু সত্যি সত্যি কাপড় ও দাঁত পরিষ্কার হয়। কারণ প্রস্রাবের মধ্যে আছে অ্যামোনিয়া যা ময়লা কাটতে সহায়তা করে।
এজন্য সে যুগে তো বটেই পরবর্তীকালে ফ্রান্সে ১৩ থেকে ১৫ শতক পর্যন্ত কাপড় ধোয়া, দাঁত মাজা ও মুখমণ্ডল ধোয়াতেও ব্যবহৃত হতো মানুষের প্রস্রাব। ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুই অবশ্য দাঁত পরিষ্কারে মূত্র ব্যবহার করতেন না। ৪০ বছর বয়সেই তিনি তার সমস্ত দন্ত হারিয়ে দান্তিকভাবে নিঃস্ব হয়েছিলেন। এজন্য স্যুপ ও নরম জাতীয় খাবার ছাড়া তিনি অন্য কোনো খাবার খেতে পারতেন না। দন্তবিহীন ছিলেন বলে তাঁর মুখে দুর্গন্ধ বেশি পরিমাণ হতো, এজন্য তিনি প্রতিদিন সকালে রোজমেরি, গোলাপ ও বিভিন্ন সুগন্ধি ফুলের নির্যাস ও পানি দিয়ে কুলকুচি করতেন। ফ্রান্সের সম্রাট চতুর্দশ লুই ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি সম্রাট ছিলেন। তিনি প্রায় ৭৬ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। ছিলেন ভীষণ রকমের সুগন্ধিপ্রেমী। প্রথম দিকে তাঁর প্রিয় সুগন্ধ ছিল কস্তুরী, আম্বর ও সিভেট। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেসব সুগন্ধির প্রতি ক্রমে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠেন তিনি। একসময় শুধু কমলা ফুলের গন্ধ ছাড়া অন্য কোনো সুগন্ধি সহ্যই করতে পারতেন না। তাঁর এ কমলা ফুলের সুগন্ধির প্রতি অনুরক্ততা ইতিহাসে নতুন এক ধরনের সুগন্ধির জন্ম দিয়েছিল যার নাম ‘নিরলি’। নিরলি সুগন্ধি সাধারণত বিটার অরেঞ্জ ফুলের নির্যাস থেকে তৈরি হয়। রাজা লুই সমস্ত ভার্সাই প্রাসাদ নিরলি সুগন্ধে ভরপুর করে দিতে হাজারখানেক কমলা গাছ স্থাপন করেছিলেন প্রাসাদের ভিতরে। ভার্সাই প্রাসাদে মোট কক্ষের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৮০০। সে সময় সেখানে রাজ অমাত্য ও পারিষদ মিলিয়ে বসবাস করত ৫ থেকে ৬ হাজার মানুষ। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে, ভার্সাইয়ের পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থা ছিল বেশ দুর্বল। বেশির ভাগ কক্ষের সঙ্গে ছিল না কোনো শৌচাগার। কক্ষের বাসিন্দারা রুমে বসেই প্রাতঃকৃত্য অর্থাৎ পটি করতেন এবং সকালে আয়াবুয়ারা এসে সেগুলো নিয়ে পুরীষভাগাড়ে ফেলতেন। তবে কিছু ভৃত্য ছিল অলস প্রকৃতির। তারা কক্ষের জানালা দিয়ে নিচে ছুড়ে ফেল দিত সেসব মলমূত্র। সে সময় হয়তো দেখা গেল নিচ দিয়ে কেউ হেঁটে যাচ্ছে তার মাথা ও শরীরে পড়ল সেই মনুষ্যবিষ্ঠা। এসব দেখে সম্রাট লুই প্রাসাদের বাইরে বেশকটি গণশৌচাগার তৈরি করিয়েছিলেন এবং সেই সঙ্গে এসব অপকর্মকারীর জন্য জেল-জরিমানারও বিধান করেছিলেন। প্রাসাদে ১০ থেকে ২০টি কক্ষ অন্তর অন্তর কমন শৌচাগার থাকত। তবে অতিরিক্ত চাপে মাঝেমধ্যে প্রাসাদের দেয়াল ছিদ্র হয়ে মলমূত্র ছিটকে বেরিয়ে আসত। এজন্য প্রাসাদের অভ্যন্তরের পরিবেশ ছিল দুর্গন্ধময় ও দুর্বিষহ। লুই নিজেই মাঝেমধ্যে তার নিজের কক্ষের জানালা খুলে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতেন। সে দুর্গন্ধ দূর করতেই প্রাসাদে এ কমলা গাছ স্থাপন। শুধু প্রাসাদের ভিতরেই তিনি কমলা গাছ স্থাপন করেননি। প্রাসাদের সামনে বিশাল উদ্যানেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার দশেক নানা জাতের কমলা গাছ এনে রোপণ করেছিলেন তাঁর বাগানে।
লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
Email : barristershaifur@yahoo.com