রবিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

কথার চেয়ে কাজের দাওয়াত বেশি কার্যকর

আল্লামা মাহ্‌মূদুল হাসান

মানুষকে দাওয়াত দেওয়ার মাধ্যম দুটি। একটি কথা, অন্যটি কাজ। ঘরে বাবা যদি কম কথা বলেন, রাগারাগি কম করেন, টেলিভিশন দেখা একেবারে বন্ধ রাখেন তাহলে দেখবেন ছেলেরাও সেগুলো মানতে ও পালনের চেষ্টা করবে। সূর্য কথা বলে না কিন্তু সে মানুষের শরীরের ভিতর পর্যন্ত গরম করে ফেলে। ফ্যান কোনো কথা বলতে পারে না কিন্তু সে তার বাতাসের মাধ্যমে মানুষের সমস্ত শরীর শীতল করে ফেলে। মোট কথা, কথার চেয়ে কাজের মাধ্যমে দাওয়াত দিলে তা বেশি কার্যকর হয়।

যারা দায়ি ও মুবাল্লিগ, তাদের নাম আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের তালিকায় ওপরের সারিতে থাকে। অন্তরে যার কলমা তৈয়বা আছে তারা সবাই ‘দায়ি’ হওয়ার যোগ্য। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কলমা পড়বে সে আমার দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। আমার অবর্তমানে আমার কাজগুলো সে করবে।’ যদি কেউ বলে যে আমি আলেম নই, আমি কৃষক বা ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার তাহলে এটা তার আসল পরিচয় হবে না, তার আসল পরিচয় হলো সে আখেরি নবীর উম্মত বা রুহানি সন্তান। পিতা না থাকা অবস্থায় সন্তানের দায়িত্ব হয় পিতার পরিবার, ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকান-ফ্যাক্টরি ইত্যাদি পরিচালনা করা। এটা যদি সন্তানের পক্ষে সম্ভব না হয় তাহলে মানুষ বলবে এরা অযোগ্য সন্তান, এরা থাকা না থাকা বরাবর।

বস্তুত রসুল (সা.)-এর ইলমের ফ্যাক্টরির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলো, নিজে আলেম হওয়া এবং অন্যকে আলেম বানানো। তদ্রূপ ইলম অনুযায়ী নিজে আমল করা এবং অন্যকে আমলের প্রতি দাওয়াত দেওয়া। মনে রাখতে হবে, রসুল (সা.)-এর দীন ও শরিয়তকে দীন সম্পর্কে অজ্ঞ ও গাফেল লোকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব প্রত্যেক সমঝদারেরই। কৃষক, ইঞ্জিনিয়ার, অফিসারকে জিজ্ঞাসা করা হবে না যে, তুমি আলেম ছিলে কি না? বরং জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি শরিয়তের ব্যাপারে যা জানতে তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেছিলে কি না? নামাজ পড়া ফরজ, ঘরে-বাইরে পর্দা করা ফরজ, এ ধরনের অনেক বিধানই তো তুমি জানতে। এসব বিষয় অন্যকে জানানোর কী প্রচেষ্টা চালিয়েছ? তোমার অধীনদের এসব শিক্ষা দিয়ে আমলের ওপর ওঠানোর জন্য কেমন ফিকির ও মেহনত করেছ? তাদের পার্থিব ক্ষণস্থায়ী জীবনের ব্যাপারে তো দিনের পর দিন ফিকির করেছ, অথচ স্থায়ী জীবনের ব্যাপারে রয়েছ উদাসীন।

বলছিলাম যে, কাজের মাধ্যমে প্রদত্ত দাওয়াতটাই অধিক ক্রিয়াশীল হয়। আপনি যদি নামাজের পাবন্দ হন তাহলে আপনার শ্রমিক যারা নামাজ পড়ে তাদের নামাজের প্রতি উৎসাহ আরও বৃদ্ধি পাবে আর যারা পড়ে না তাদের অন্তরেও এ অনুশোচনা সৃষ্টি হবে যে, আমার ফ্যাক্টরির মালিক নামাজ পড়ে, আজানের জওয়াব দেয়, এভাবেই হয়তো সে আল্লাহর নিয়ামত পেয়ে কোটিপতি হয়েছে। তাই রবের মর্জি ও নিয়ামত পাওয়ার জন্য আমাকেও নামাজ পড়তে হবে, আজানের জওয়াব দিতে হবে। মুয়াজ্জিন আজান দেয় আর এ আওয়াজ শত শত, হাজার হাজার মানুষ শ্রবণ করে এবং মুয়াজ্জিনের কথার সঙ্গে কথা মেলায়। এরপর মুয়াজ্জিনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মসজিদে নামাজ পড়তে চলে আসে। অতএব মুয়াজ্জিন যদি জান্নাতের টিকিট পায় তাহলে তার ডাকে সাড়া দানকারীরাও পাবে বলে আশা করা যায়। হাদিসে এসেছে, কাল হাশরের ময়দানে মুয়াজ্জিনের গর্দান অনেক লম্বা হবে, তার চেহারায় নুর চমকাতে থাকবে।

এক মসজিদে আজান হলে অন্য মসজিদে ওয়াজ বন্ধ রাখা জরুরি নয়। এ আমলটির গুরুত্ব ও ফজিলত না জানার কারণে, কিংবা জানলেও অন্তরে সর্বদা তা উপস্থিত না থাকার কারণেই এ গাফিলতি তথা উদাসীনতা সৃষ্টি হয়েছে। আমরা ছোট ছোট আমলের প্রতি গুরুত্ব দিই না। অথচ এগুলো আল্লাহর মহা অনুগ্রহ। কারণ মানুষের স্বভাব হলো কঠিনকে এড়িয়ে চলা। তাই আমাদের প্রতিপালক আমাদের স্বভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সহজ সহজ আমল দান করেছেন। একই সময়ে কয়েক মসজিদের আজান শুনলে প্রথম আজানের জওয়াব দিলেই হয়ে যাবে। তবে বেশি সওয়াব পেতে চাইলে প্রতিটির আলাদা আলাদা জওয়াব দিতে হবে। তবে সেই আজানেরই জওয়াব দিতে হবে যা সহি-শুদ্ধভাবে এবং সুন্নত তরিকায় দেওয়া হয়। ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রসুলুল্লাহ’র জওয়াব হলো তা-ই যা আজানে বলা হয়। ‘হাইয়্যা আলাস সালাহ’ এবং ‘হাইয়্যা আলাল ফালাহ’র জওয়াব হলো ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’। কিন্তু যদি কেউ এটা না জানে তাহলে হুবহু আজানের শব্দ বলে দিলেও জওয়াব হয়ে যাবে। ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম’- এর জওয়াব হলো ‘সাদাকতা ওয়াবারারতা’। এ বাক্যের অর্থ হলো, হে মুয়াজ্জিন! তুমি ঠিক বলেছ যে, ঘুমের চেয়ে নামাজ ভালো। তাই ঘুম ছেড়ে নামাজ পড়তে মসজিদে এসে নামাজ আদায় করলাম। আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার এই নামাজের যদি প্রতিদান পেয়ে থাকি তাহলে হে মুয়াজ্জিন, তুমিও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। কারণ তুমিই তো আহ্বান করে মসজিদে আমাকে নিয়ে এসেছ।

লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ

সর্বশেষ খবর