সোমবার, ২৯ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আরেকটি বিজয় নাকি আত্মসমর্পণ

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আরেকটি বিজয় নাকি আত্মসমর্পণ

পাকিস্তানের কিছু বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার বলেছেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী সামরিক শাসনের মাধ্যমে বেশ কয়েকবার নিজ দেশ জয় করতে পারলেও ভারতের সঙ্গে প্রতিটি যুদ্ধে লজ্জাজনক পরাজয়বরণ করেছে। ২০২২ সালের এপ্রিলে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের ক্ষমতাচ্যুতি এবং তার জের ধরে ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের লাগাতার হুমকি ও তার অনুসারীদের সহিংস আন্দোলন সম্প্রতি যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে শিরোনামে উল্লিখিত কথাটি আবার সবার সামনে এসেছে। গত ৯ মে একটি দুর্নীতি মামলায় লাহোর হাই কোর্টে হাজিরা দিয়ে বের হওয়ার সময় আদালত চত্বরেই বিশাল বহর নিয়ে আধাসামরিক বাহিনী রেঞ্জারস ইমরান খানকে গ্রেফতার করে। তার জের ধরে ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন পিটিআই দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মী ও সমর্থক লাহোরসহ পাকিস্তানের সব বড় বড় শহরে সহিংস বিক্ষোভে নেমে পড়েন। পাকিস্তানের ৭৬ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম যে একটি রাজনৈতিক দল ও তার সমর্থকরা শুধু আন্দোলন বা মৌখিক হুমকি নয়, সরাসরি আক্রমণ চালিয়েছেন সেনাবাহিনীর স্থাপনার ওপর। ৯ মে ক্ষুব্ধ পিটিআই সমর্থকরা রাওয়ালপিন্ডিতে সেনাবাহিনীর সদর দফতরের প্রধান গেট ভেঙে ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা করেন। এ সময় লাহোরের কোর কমান্ডারের বাসা শুধু আক্রমণ নয়, সেখানে আগুন দেওয়া ও লুটপাট করা হয়। অন্যান্য ক্যান্টনমেন্ট শহরেও প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটে। লাহোর কোর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফাইয়াজ গণির বাসা থেকে একটা পোষা জীবন্ত ময়ূর এক বিক্ষোভকারী লুট করে নিয়ে আসেন, যার ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়। পাকিস্তানের ইতিহাসে এর সবকিছুই অভাবনীয় ঘটনা। এখনো মার্শাল ল জারি হয়নি কেন এটাই অনেকে ভাবছেন। কিন্তু বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতা ও পূর্বের সামরিক শাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতায়, সাপ মরবে লাঠি ভাঙবে না- এ দর্শনে বর্তমান সেনা নেতৃত্ব এগোতে চান বলে অনেকে মনে করছেন। আবার অন্য তত্ত্বও পাকিস্তানের মিডিয়াবাজারে আছে। কেউ কেউ বলছেন, সেনাসদর আক্রান্ত, কোর কমান্ডারের বাসায় আগুন আর পাহারারত সেনা সদস্যরা তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন, এটা কী করে হয়। তাদের ধারণা, এটা হয়তো পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা, আইএসআইর সাজানো নাটক, যার উদ্দেশ্য হতে পারে এ অজুহাতে ইমরান খান ও তার দলকে দেশদ্রোহী ঘোষণা দিয়ে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করে দেওয়া অথবা হতে পারে সামরিক শাসন জারির উপযুক্ত অজুহাত সৃষ্টি। আসল উদ্দেশ্য অচিরেই জানা যাবে। সরকারের ভাষ্যমতে, ওইদিন পুলিশের গুলিতে আটজন নিহত হয়েছেন। সেনা সদস্যরা গুলি চালিয়েছেন এমন কোনো খবর দেখা যায়নি। পিটিআই বলেছে, ওইদিন তাদের ৪৮ জন নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। গ্রেফতার হওয়ার দুই দিনের মাথায় লাহোর হাই কোর্ট ইমরান খানের জামিন মঞ্জুর এবং ৩১ মে পর্যন্ত পুনরায় গ্রেফতার না করার নির্দেশ জারি করেছেন। পরবর্তীতে আরেকটি আদালত ইমরান খানকে ৮ জুন পর্যন্ত জামিন দিয়েছেন। তাতে ইমরান খানের সমর্থকরা ভীষণভাবে উল্লসিত। ৮ জুন পার হওয়ার পর কী হবে সেটা নিয়ে এখন অনেক জল্পনা-কল্পনা চলছে। সেনাবাহিনীর স্থাপনার ওপর আক্রমণের অভিযোগে পিটিআইর কয়েক শ নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পাকিস্তানের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সেনাপ্রধান জেনারেল অসিম মুনীর বলেছেন, সেনা স্থাপনার ওপর আক্রমণ সহ্য করা হবে না। ৯ মে ও তার পরবর্তী দিনের সহিংস ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে ইঙ্গিতপূর্ণ তিনটি বিষয়ের উল্লেখ আছে। প্রথমত, ৯ মে তারিখের ঘটনা দেশের জন্য এক কালো অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। দ্বিতীয়ত বলা হয়েছে- সেনা স্থাপনার ওপর আক্রমণ ভবিষ্যতে আর সহ্য করা হবে না। তৃতীয়ত, বিচার সেনা আইন অনুসারে সেনাবাহিনী কর্তৃক গঠিত আদালতে হবে। এর মধ্য দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে সেনাবাহিনী একপ্রকার মুখোমুখি অবস্থানে চলে গেল। সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ কাঠামো কোর কমান্ডারদের আনুষ্ঠানিক সভায় সেনাপ্রধান জেনারেল অসিম মুনীর উপরোক্ত সিদ্ধান্তগুলো দিয়েছেন। ৯ মে গ্রেফতার হওয়ার মাত্র দুই দিনের মাথায় ৩১ মে পর্যন্ত আগাম জামিন পেয়ে লাহোরের বাসভবন থেকে ইমরান খান মিডিয়ার মাধ্যমে প্রায় এক ঘণ্টার এক দীর্ঘ ভাষণ দেন। তাতে তিনি বারবার ইতিহাস ও ধর্ম প্রসঙ্গ এনেছেন এবং সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নে পাকিস্তানে আরেকটি ভাঙন দেখা দিতে পারে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। আবেগঘন ভাষণে সবাইকে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করার আহ্বান জানিয়েছেন। ভাষণে সমগ্র সেনাবাহিনীর নয়, সেনাপ্রধান জেনারেল অসিম মুনীরকে টার্গেট করে বক্তব্য দিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির ইঙ্গিত দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে সামরিক অভিযান পরিচালনার ফলে পূর্ব পাকিস্তান হাতছাড়া হয়ে বাংলাদেশ জন্ম হওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান স্থায়ীভাবে ভেঙে যাওয়ার যে ইতিহাস তার থেকে শিক্ষা নিতে তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান। ২০২২ সালের এপ্রিলে জাতীয় সংসদে অনাস্থা ভোটে ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুতি এবং পিপলস পার্টি ও মুসলিম লীগসহ কয়েকটি দল নিয়ে গঠিত পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্টের (পিডিএম) ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে গত এক বছরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা, কোনো ফ্রন্টেই কোনো উন্নতি হয়নি, বরং সব ক্ষেত্রে অবস্থা ক্রমশই আরও তলানির দিকে যাচ্ছে। পাকিস্তানের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী বেনামি রাজনৈতিক দল সেনাবাহিনী গত ৭৬ বছরের বেশির ভাগ সময় সরাসরি, আবার কখনো কখনো রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতার পুতুল বানিয়ে পরোক্ষভাবে দেশ শাসন করেছে। এই সময়ে এসে সেনাবাহিনীর জন্য এখন উভয় সংকট অবস্থা। দীর্ঘ ৭৬ বছর ধরে ক্ষয়রোগে আক্রান্ত রোগীর মতো আজ এমন শোচনীয় অবস্থায় পড়েছে যে, রাজনৈতিক অথবা সামরিক কোনো ওষুধেই আর পাকিস্তানকে বাঁচানো যাবে কি না সেই সন্দেহ এখন খোদ সেনাবাহিনীর র‌্যাঙ্ক ও ফাইলের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক খেলে তা এক সময়ে আর কাজ করে না। সামরিক শাসনের বেলায় এমনই অবস্থা এখন পাকিস্তানের। কিন্তু রাজনৈতিক সমাধানের পথ পাওয়া না গেলে হয়তো শেষ পর্যন্ত সামরিক শাসন আসবে। তবে বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় সামরিক শাসনের গ্রহণযোগ্যতা একেবারে শূন্যের কোঠায়। সামরিক শাসন জারি হলেও অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সংকট সামাল দেওয়া প্রায় অসম্ভব কাজ হবে। কারণ বিশ্ব অঙ্গন থেকে আর্থিক সহায়তা পাওয়া আরও কঠিন হয়ে যাবে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা ও মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে উগ্রবাদী সশস্ত্র সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) তাদের অভিযানকে আরও বৃদ্ধি ও শক্তিশালী করবে। পাকিস্তান থিঙ্কট্যাংক সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের তথ্যমতে, ২০২২ সালে টিটিপি এবং অন্যান্য সশস্ত্র সংগঠনের আক্রমণে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর ২৮২ জন শুধু নিহত হয়েছে, আহত হওয়ার সংখ্যা অনেক বেশি। ২০২১ সালে টিটিপি পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ২৮২টি আক্রমণ চালায়, যার মধ্যে আত্মঘাতী আক্রমণও ছিল। রয়টার্স পরিবেশিত খবরে প্রকাশ, ২৩ মে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্রে জঙ্গি হামলায় চার পুলিশ ও দুই নিরাপত্তারক্ষী নিহত হয়েছেন। সামরিক শাসন বাদ দিয়ে রাজনৈতিক সমাধানের দিকে যে যাবে তার পথও ক্রমশই ধূসর হয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন শাহবাজ শরিফ সরকারের চতুর্দিকের ব্যর্থতায় সম্প্রতি এক জরিপে দেখা যায়, পাকিস্তানের শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ ইমরান খানকে সমর্থন করছেন। তবে ২৩ মে পাকিস্তানের ডন পত্রিকার খবরে দেখলাম একশ্রেণির সিনিয়র নেতা ইমরান খানের দল ত্যাগ করতে শুরু করেছেন। তার মধ্যে প্রভাবশালী নেত্রী শিরিন মাজারিও রয়েছেন। তবে দল ভাঙার কৌশল আগে সফল হলেও তা এ সময়ে এসে কতটা কার্যকর হবে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কারণ সত্তর দশকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর ফাঁসি এবং নব্বই দশকে ১০ বছরের মধ্যে পিপলস পার্টির বেনজির ভুুট্টোকে দুবার ও মুসলিম লীগের নওয়াজ শরিফকে তিনবার মেয়াদপূর্তির পূর্বে সেনাবাহিনীর অঙ্গুলি হেলনে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করা হলেও সে সময়গুলোতে আজকের মতো শক্তিশালী প্রতিবাদ হয়নি। তাই এবারের পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। ইমরান খানের রাজনৈতিক উত্থান ও ক্ষমতায় আরোহণ সেনাবাহিনীর হাত ধরে হওয়াতেই তিনি পরিচিত ছিলেন ক্যান্টনমেন্টের পুতুল হিসেবে। কিন্তু ইমরান খানের দ্বিচারিতা, নীতিভ্রষ্টতা, পারিবারিক দুর্নীতি ও তার জের ধরে আইএসআইর সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থান এবং শেষ দিকে এসে বৈশ্বিক ভূরাজনীতির চাল বুঝতে ভুল করার মধ্য দিয়ে দুই পক্ষের অবস্থান এখন যোজন যোজন দূরে। কিন্তু সেনাবাহিনীর আশীর্বাদপুষ্ট বর্তমান শাহবাজ শরিফ সরকারের গত এক বছরে দেশের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির চরম অবনতির ফলে মানুষ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেই ফুঁসে উঠেছে। ঐতিহাসিক লিগেসির কারণে পিপলস পার্টি ও মুসলিম লীগের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্ক কখনোই স্বস্তিকর ছিল না। কিন্তু ইমরান খানকে সরানোর বাধ্যবাধকতায় অন্য কোনো বিকল্প না থাকায় তখন শাহবাজ শরিফের কোয়ালিশন সরকারকে তাদের মেনে নিতে হয়েছে। তাই সেনাবাহিনীর সামনে রাজনৈতিক বিকল্প এখন নেই বললেই চলে।

সুতরাং আগামীতে কী হতে যাচ্ছে এটা এখন পাকিস্তানে বিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। হতে পারে নরম-গরম উভয় পন্থার প্রয়োগে ইমরানের দল ভেঙে অকার্যকর হয়ে যাবে। তাতে কাজ না হলে ৯ মে সেনা স্থাপনা আক্রমণের অভিযোগে দেশদ্রোহিতার আইনে পিটিআইকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে। তারপর অক্টোবর-নভেম্বরে নির্ধারিত জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করা। তাতে নির্বাচনটি এমনভাবে সাজানো হতে পারে যার মধ্য দিয়ে বর্তমান কোয়ালিশন সরকার আবার ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু এ সরকারকে চেক দেওয়ার জন্য উগ্রবাদী ইসলামিস্ট দলগুলোর জাতীয় সংসদে উল্লেখযোগ্য আসন থাকবে। দ্বিতীয় বিকল্প হতে পারে অন্তত এক বছরের জন্য জরুরি আইন জারি করা। তার মধ্য দিয়ে সব ফ্রন্টে একটা স্থিতিশীল পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা এবং তাতে সফল হলে তারপর জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন। উপরোক্ত দুটি বিকল্পের কোনোটাই বাস্তবসম্মত না হলে সামরিক আইন জারি করা ছাড়া সেনাবাহিনীর হাতে আর কোনো বিকল্প থাকবে না। সেটা হলে নিজ দেশ জয় করার আরেকটি কৃতিত্ব সেনাবাহিনী পেতে পারে।  যেমন কৃতিত্ব সেনাবাহিনী ইতিপূর্বে অর্জন করেছে আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, জিয়াউল হক ও পারভেজ মোশাররফের নেতৃত্বে। এবার জেনারেল অসিম মুনীরের পালা। এটা করতে না চাইলে ইমরান খানের কাছে সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। আসলে কী হবে, দিজ অর দ্যাট। আর কয়েকটি দিন অপেক্ষা করুন।

 

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

[email protected]

সর্বশেষ খবর