কৃষিনির্ভর অর্থনীতি হওয়ার পরও এক সময় এ দেশে কৃষি ও কৃষক হয়ে উঠেছিল অবহেলিত এক বিষয়। কৃষিকে বলা হতো ‘বাপ-দাদার পেশা’। যে পেশার প্রতি তরুণদের কোনো আগ্রহ ছিল না। অথচ বহুল জনসংখ্যার ক্ষুধার্ত দেশটির খাদ্য চাহিদা পূরণে প্রয়োজন ছিল ব্যাপক ফলনের। প্রয়োজন ছিল আধুনিক কৃষির সঙ্গে কৃষককে পরিচিত করে তোলার। সরকার ও গণমাধ্যমের ব্যাপক প্রচার-প্রচারণায় মাছ চাষ, মুরগি পালন, শাক-সবজি উৎপাদন অর্থাৎ ধান-পাটের কৃষি থেকে কৃষির বৈচিত্র্যায়নের মাধ্যমে কৃষি উন্নয়নের সূচনা হয়েছিল তরুণদের হাতে। আমি বলব, শিক্ষিত তরুণরা যখন কৃষিতে যুক্ত হতে শুরু হলো তখন থেকেই কৃষি বের হতে শুরু হয়েছিল সনাতনী ভাবনা থেকে। তরুণদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছাড়া এই খাতটির প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব ছিল না। আজকের বাংলাদেশের পুষ্টি উন্নয়নে কৃষিতে তরুণদের অংশগ্রহণ যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে। এক সময় গ্রামাঞ্চলে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালনই ছিল কৃষকের বাড়তি আয়ের উৎস। কিন্তু তরুণরা হাঁস-মুরগি পালন, গরুর খামার বা মাছের খামার করে শুধু নিজেই স্বাবলম্বী হননি, অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন এমন হাজার হাজার মানুষের গল্প গত ৪০ বছরে আমি তুলে ধরেছি। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই তরুণ। এ দেশের কর্মসংস্থানেও তারুণ্যের ভূমিকা অসামান্য। বাংলাদেশের উন্নয়নের পরিসংখ্যানে চোখ রাখলে আমরা দেখতে পাই, আমাদের শিক্ষার হার বেড়েছে কিন্তু সে অনুপাতে বাড়েনি কর্মসংস্থান। প্রতিবছর নতুন নতুন মুখ যুক্ত হচ্ছে বেকারত্বের ঘরে। বর্তমান তরুণ সমাজের বড় অংশই বেকার, অনিশ্চিত জীবনের পথে। কোনো দেশের জনশক্তির তুলনায় কর্মসংস্থানের স্বল্পতার ফলে সৃষ্ট সমস্যাই বেকার সমস্যা। বাংলাদেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নের পথে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, বেকার সমস্যা এর মধ্যে অন্যতম।
৪০ বছরে বাংলাদেশে কৃষির যে পটপরিবর্তন আমার দেখার সুযোগ হয়েছে, আর বছর ২০ ধরে বিশ্ব কৃষির যে রূপরেখা দেখে এসেছি, তাতে ভবিষ্যৎ ভাবনার জায়গাটিতে বারবার মনে হয়েছে, শিক্ষিত তরুণদেরই পৃথিবীকে এগিয়ে নিতে প্রস্তুত করতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, পোশাকশিল্পসহ অন্যান্য শিল্প নিয়ে আমরা যতটা অগ্রসর হওয়ার কথা চিন্তা করেছি, কৃষিশিল্প নিয়ে ততটা ভাবিনি। আমরা ভেবেছি, কৃষক তাঁর মতো করেই তাঁর নিজের খাদ্যের পাশাপাশি আমাদের খাদ্য উৎপাদন করবেন। আমরা নামমাত্র মূল্যে তা কিনে নেব, যদি উৎপাদন না-ও করতে পারেন, তবে আমদানি করে আনব। কিন্তু উন্নত বিশ্ব সব সময়ই বুঝেছে, নিজের খাদ্য নিজেদেরই উৎপাদন করতে হবে। তাই তারা কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি কৃষিশিল্প নিয়ে ভেবেছে। আমি ২০০৪-০৫ সালে চীন ও জাপানে গিয়ে দেখেছি কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে রাষ্ট্র তাদের কীভাবে তৈরি করেছে, সুযোগ দিয়েছে, সব ধরনের পরিবর্তনের সঙ্গে তাদের খাপ খাইয়ে নিয়ে আধুনিক করে তুলেছে। কৃষিকে একটা সমন্বিত খাত হিসেবে সাজিয়ে নিয়েছে তারা। কৃষকের সঙ্গে বীজ উৎপাদনকারী, সার উৎপাদনকারী, আবহাওয়ার বার্তা প্রদানকারী, ফসলবিমা ও ঋণের জন্য ব্যাংককে যুক্ত করে দিয়েছে। কৃষকের বাজার নিয়ে তাঁকে ভাবতে হয়নি। সব দিক থেকেই সেবা নিশ্চিত করেছে। ফলে কৃষক তাঁর সম্পূর্ণ মনোযোগ ফসল উৎপাদনে দিতে পেরেছেন। নিজের উন্নয়নের কথা ভাবতে পেরেছেন। আমাদের কৃষক এখন পর্যন্ত নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে জানেন না। জানেন না, বৃষ্টি কখন হবে, কী পরিমাণ সার বা কীটনাশক দিতে হবে। ফসলবিমার সুযোগ সেভাবে পাচ্ছেন না তাঁরা। এমনকি আমার কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট অনুষ্ঠানে কৃষক লাগাতার অভিযোগ করে গেছেন, ব্যাংকে গেলে কৃষক ঋণ পান না। আমাদের কৃষককে যতক্ষণ পর্যন্ত বীজ-সার-কীটনাশক, তথ্যসেবা, ব্যাংকের ঋণ, আবহাওয়া বার্তা, বিমা ইত্যাদির সেবা নিশ্চিত না করতে পারব, ততক্ষণ অবধি প্রকৃত কৃষির উন্নয়ন সম্ভব নয়। বলছিলাম, পরিবর্তিত সময়ে কে হবেন আগামী প্রজন্মের কৃষক। শিক্ষিত তরুণরা এখন কৃষির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন। এর কারণ স্মার্ট কৃষি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নেদারল্যান্ডসের রয়্যাল আইকোলকাম্পের কথা মনে পড়ছে। রয়্যাল আইকোলকাম্প মূলত কৃষি প্রযুক্তি ও অরগানিক কৃষি নিয়ে গবেষণা করে। আইকোলকাম্পের বিজনেস ইনোভেশন স্ট্র্যাটেজি বিভাগের ড. ইয়োখেন ফরুবিখ বলছিলেন, এখনকার কৃষি হচ্ছে ‘সেক্সি কৃষি’, যার কারণে তরুণরা এখানে যুক্ত হচ্ছেন এবং তাঁদের হাত ধরেই ক্রমাগত পাল্টে চলেছে কৃষিচিত্র। করোনা-পরবর্তী বিশ্বে মানুষের চিন্তার পরিবর্তন এসেছে। মানুষ বুঝতে পেরেছে খাদ্য উৎপাদনই উন্নয়নের মূল উপকরণ। বেঁচে থাকতে হলে খাদ্য খেতে হবে। সারা পৃথিবীই খাদ্যশিল্প নিয়ে নতুন করে ভাবছে। একদিকে যান্ত্রিক কৃষির সুনিশ্চিত উৎপাদন, অন্যদিকে কৃষি বাণিজ্যের প্রসার। ফলে ব্যবসায়ীরা কৃষি খাতে বিনিয়োগ করতে শুরু করেছেন। আমাদের দেশের ক্ষুদ্র কৃষকের পক্ষে এত বিনিয়োগ সম্ভব নয়। এ কারণে কৃষি উৎপাদন থেকে কৃষি বাণিজ্য চলে যাবে ব্যবসায়ীদের হাতে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক এই প্রযুক্তির কৃষি থেকে ছিটকে পড়বেন। প্রযুক্তি সম্পর্কে জানা-বোঝা হবে কৃষিতে দক্ষ হওয়ার মূল জ্ঞান। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সব তথ্যই কৃষকের কাছে তুলে ধরবে। প্রযুক্তি নিজেই সব কাজ সম্পন্ন করতে পারবে। যে কৃষক স্মার্ট ফার্মিংয়ে ড্রোন, স্যাটেলাইট ইমেজ, সেন্সর ও জিপিএসের মতো প্রযুক্তিকে আরও দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করবেন, তিনি হয়ে উঠবেন সফল। ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং আবহাওয়া অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা এবং আলোসহ ইনডোর ফার্মিং উন্নত দেশগুলোতে প্রাধান্য পাচ্ছে। আমাদের কৃষি এখনো আবহাওয়ানির্ভর। কিছু ফসলের অঙ্কুরোদ্গম এবং বিকাশের জন্য উচ্চ বা নিম্ন তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। উপরন্তু আর্দ্রতা, কীটপতঙ্গের উপদ্রব এবং রোগের সঙ্গে তাপমাত্রা একত্র করে পূর্বাভাসের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। ওয়েদার মনিটরিং প্রযুক্তির মাধ্যমে পূর্বাভাস দিয়ে ফসল সুরক্ষা, বপন, ফসল কাটার পাশাপাশি অন্যান্য কৃষি কার্যক্রমের পরিকল্পনায় সহায়তা পাবেন কৃষক। আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষক বায়ু এবং মাটির তাপমাত্রা, মাটির আর্দ্রতা, সামগ্রিক আর্দ্রতা, বাতাসের গতি, দিক এবং বৃষ্টিপাতের মতো বিষয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে পারেন। এমনকি নানান তথ্যের পাশাপাশি বৃষ্টি পরিমাপের একটি তথ্য পেতে পারেন। এমন প্রযুক্তি সেবা কৃষকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে কয়েক দশকের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৃষি উদ্ভাবন হচ্ছে প্রিসিশন অ্যাগ্রিকালচার’। প্রিসিশন অ্যাগ্রিকালচার প্রযুক্তি আজকের কৃষিতে একটি বড় গেমচেঞ্জার হতে পারে। এর মাধ্যমে অধিক পরিমাণ কৃষি উৎপাদনের জন্য সঠিক সময়ে, সঠিক পরিমাণ পানি, সার, কীটনাশক ইত্যাদি প্রয়োগ করা হয়, যাতে সঠিক পরিমাণ ফসল, মাটি সঠিক সময়ে ও স্থানে স্বাস্থ্য এবং উৎপাদনশীলতার জন্য যা প্রয়োজন তা পায়।
বিশ্ব কৃষির সঙ্গে পাল্লা দিতে আমাদের কৃষিকে আধুনিক করার তাগিদ আমি বহুদিন ধরে দিয়ে আসছি। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই সময়ে কৃষিতে বহুমুখী প্রযুক্তির ব্যবহারের পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ ইন্টারনেট অব থিংসের ব্যবহার বাড়াতে হবে। আর এ জন্য আমাদের তরুণদের প্রস্তুত করতে হবে। এতে প্রশিক্ষণ আর গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের তরুণদের হাত ধরেই কৃষি বাণিজ্যের পথ দীর্ঘ হচ্ছে। হাতের মোবাইল ফোনটি হয়ে উঠেছে তথ্যের ভান্ডার।
বড় শিল্পোদ্যোক্তা থেকে ছোট চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ী অনেকেই খুঁজে নিচ্ছেন কৃষিভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য। আজকে আমাদের তারুণ্যের শক্তি পরীক্ষিত। তারা যে কোনো পরিস্থিতিকে পাল্টে দিতে পারে। এই শক্তি ইতিবাচকভাবে যে খাতেই কাজে লাগানো যায় পরিবর্তন আনবেই। বিশেষ করে কৃষিতে কার্যকরী পরিবর্তন আনতে তারুণ্যের বিকল্প নেই। আমরা তাদের দিকেই তাকিয়ে আছি।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব