সেই স্বর্গবাসের কাল থেকে বিভেদ-বিভাজন চলে আসছে। আদি চাচারা, হাবিল কাবিল বিভাজন মতানৈক্যের ফেরে পড়ে প্রথম খুনোখুনির শিকার হয়েছিলেন। আমাদের এ প্রিয় বাংলাদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন আন্দোলনে যারা নিহত হয়েছেন তাদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানাই। হিসাব কষে বের করা যাবে এ শতসহস্র আত্মত্যাগের অন্যতম প্রেরণা ছিল নিজেরাই নিজেদের শত্রুতায় সৃষ্ট বিভেদ-বিভাজন বৈষম্য থেকে মুক্তি।
তুলনার জন্য বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই, মাত্র ২৬৭ বছর আগে এই ভারতবর্ষে সিপাহসালাদের বিশ্বাসঘাতকতার পরিণতিতে ইংজেদের এ দেশে আগমন এবং এদেশীয়দের মধ্যে বিভেদ-বিভাজন সৃষ্টি করে বৈষম্য বঞ্চনার বেড়াজালে আটকে ১৯০ বছর এবং পাকিস্তানি সংসার মাত্র ২৪ বছর টিকেছিল। বিভেদ-বিভাজক বৈষম্য সৃষ্টিকারী এখন নিজেদের ঘরে এবং তার প্রেরণা ও প্রযোজনা পাশের বাড়ি থেকে।
১৯৪৫ সালে লন্ডনে বসেই চার্চিল সাহেব ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দেওয়ার নামে যেভাবে ভারত ভাগের চাল চেলেছিলেন তা ছিল ঐক্যবদ্ধ ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করা; তার অন্যতম কূটকৌশল ছিল ভারতের প্রধান দুই সমৃদ্ধ অঞ্চল বাংলা ও পাঞ্জাবকে দ্বিখণ্ডিত করে দুই পরম শত্রুর সংসারে গুছিয়ে দেওয়া। ফলশ্রুতিতে ভয়াবহতম মানবিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছিল বাংলা ও পাঞ্জাবের মানুষ। আজও আঞ্চলিক অর্থনীতি ও সমৃদ্ধি সাধনের পথে অন্তরায় হিসেবে আছে এ বিভেদ-বিভাজন মাসসিকতা। মি. জিন্নাহর টু নেশন থিওরিকে সমালোচনা তারাই করেন যারা ওয়ান ইন্ডিয়া হওয়ার বিরোধিতায় ছিলেন, সেটা ছিল এক ধরনের ভণ্ডামি। টু নেশন থিওরির সমালোচকরাই সাম্প্রদায়িকতার ইন্ধনদাতা হয়েও তারাই ‘অসাম্প্রদায়িকতা’র বুলি আউড়ান, অভিনয় করেন। ভারত তথা বাংলা ভাগের সময় নিছক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভেদবুদ্ধিতে কলকাতাকে পশ্চিমবঙ্গে তথা ভারতের ভাগে রাখতে যারা বদ্ধপরিকর ছিলেন তারাই পূর্ববঙ্গকে ‘পঙ্গু, ব্যর্থ ও অকার্যকর’ করতে পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রামও দাবি করে বসে। ১৩ আগস্ট (১৯৪৭) সর্দার প্যাটেল মাউন্টব্যাটেনের কাছে ‘চট্টগ্রাম ভারতের চাই পাকিস্তানকে এটা দেওয়া হবে চরম অন্যায়’ বলে যখন আলটিমেটাম দেন তখন মাউন্টব্যাটেন র্যাডক্লিফের বাঁটোয়ারা ম্যাপ (রোয়েদাদ) জারি পেছানোর পথ ধরেন। ১৪ ও ১৫ আগস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণার পর ১৭ আগস্ট র্যাডক্লিফের বাঁটোয়ারা ম্যাপ জারির দিন সাব্যস্ত হয়। মাউন্টব্যাটেন তার ডায়েরিতে লিখেছেন- ‘আগে আমি করাচি ও দিল্লির ক্ষমতা হস্তান্তর কাজ নির্বিঘ্নে শেষ করি, তারপর ১৭ তারিখ এটি জারি করলে দাঙ্গা ও হাঙ্গামা থেকে আগাম রেহাই মিলবে।’ হলোও তাই। এ প্রেক্ষাপটে এখনো চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুযোগ নিতে, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট যারা কায়েম করতে চাইছে তারা এখনো তাদের ভারতের ওপর দিয়ে ভুটান ও নেপালের সঙ্গে ট্রানজিট দিতে গড়িমসি অব্যাহত রয়েছে। আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গা ও তিস্তার পানিতে ভাটির দেশ বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্সা দিতে নানা কূটকৌশলের ক্যারিশমায় উজানে পানি সরিয়ে নিয়ে গঙ্গা ও তিস্তায় পানি প্রবাহ কমে যায়। ফলে ভাটির দেশে নদী ও নিসর্গ, অন্যতম অবলম্বন কৃষি অর্থনীতির অব্যাহত ক্ষতিসাধনসহ প্রাকৃতিক সুরক্ষা সুন্দরবনকে ধ্বংসের স্লো পয়জনিং চলছে। তিস্তার উৎসমুখ ও মধ্য পর্যায়ে পানি সরিয়ে তিস্তাকে পানিশূন্য করে এখন শোনানো হচ্ছে ‘পানি নেই তো দেব কোত্থেকে? এ ক্ষেত্রে ভূরাজনীতির ভায়রা ভাইদের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধের শিকার হচ্ছে ভাটির দেশ বাংলাদেশ। এমনকি একই দেশের কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের মধ্যে তর্কাতর্কি ও অভিনয়ে বাংলাদেশকে বোঝাতে চাওয়া হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও বাংলাদেশ (সব মিলে সেই বৃহৎ বাংলা) এর মধ্যকার বিভেদ-বিভাজন বজায় রাখতে পারলে স্বস্তি মিলবে কেন্দ্রের এবং সুদূরপ্রসারী সেই পরিকল্পনা তারা যেন বন্ধুত্বে এক না হতে পারে তার পথ পরিষ্কার করা।
প্রতিবেশী রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের কানেকটিভিটির মন্ত্র পড়িয়ে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সাত রাজ্যে যাওয়ার পথ ট্রানজিট নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সাত রাজ্যের কানেকটিভিটির সম্ভাবনা ও সুযোগকে গলা টিপে হত্যা করা এবং এমনকি সেখানকার স্বাধীনতার স্বপ্নকে দমন করা। আস্তে আস্তে এটাও স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে মাতারবাড়ী ও সোনাদিয়ায় জাপানি সহায়তায় গড়ে তোলা জাপানের বিগ বি বিশাল অবকাঠামোর সুযোগ সম্প্রসারিত করা হবে সেই সাত রাজ্যে। এখানেও এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের সাফল্যের স্বপ্ন দেখা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক নদীর পানির হিস্সা দিতে গড়িমসি করলেও বাংলাদেশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজস্ব ফেনী নদীর পানি দেওয়ায় সমতার ভিত্তিতে সহঅবস্থানের অধিকার নিয়ে নেগোসিয়েশনে নীতি কৌশলের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। এসবই সেই সনাতন বিভেদ-বিভাজন মানসিকতার ফলশ্রুতিতে।
ভূরাজনীতির বিভাজন ক্রীড়াকৌশল এখন দেশ অভ্যন্তরেও দুরারোগ্য ব্যাধির মতো গেড়ে বসেছে। দগদগে ঘা যেমন তেমনি ৫৩ বছর বয়সি বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তির শিরোনামে বিভক্ত করা হয়েছে। সেই ভিত্তিতে রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যকার দেয়াল উধাও, দ্বিধাবিভক্ত প্রশাসন জনসেবা বিচার বিভাগ সবই। বাংলাদেশের প্রশাসন দলীয়করণ গ্রেশাম সিনড্রোমের কবলে পড়েছে বলে প্রয়াত আকবর আলি খান একটা আলাদা বই-ই লিখেছেন। পিএসসিতে সর্বোচ্চ পদে নিয়োগের সুপারিশ পেয়েও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রার্থী নিয়োগই পায় না অদৃশ্য কারণে। কোটা আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের দুদুবার নামতে হয়েছে, অসংখ্য তরুণের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। মেধার অবমূল্যায়নের দ্বারা প্রকারান্তরে দেশ ও জাতিকে মেধাশূন্য করার, মানবাধিকার লঙ্ঘনের এমন উদগ্র বাসনা কেন ও কার স্বার্থে? কার স্বার্থে চাকরিতে ওএসডি কালচারের নামে প্রশাসনের মেধাবী ও করিৎকর্মাদের সরিয়ে, হাজার হাজার কর্মকর্তাকে বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিয়ে পাবলিক মানির ক্ষতিসাধনসহ প্রশিক্ষিত মানবসম্পদকে অকর্মন্য করে অপচয় এবং তদস্থলে দলীয় অদক্ষ প্রার্থীদের রাষ্ট্রীয় বড় বড় পদে নিয়োগের পাঁয়তারাটি সাম্প্রতিককালে কোটা আন্দোলন বৈষম্যবিরোধী অন্দোলনে রূপ নেওয়ায় এ বিষয়টি সামনে চলে আসে। ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত অন্যের ভেদবুদ্ধি, প্ররোচনা ও প্রযোজনায় নিজের নাক কেটে (নিজের ভবিষ্যৎ মানবসম্পদ ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ধ্বংস করে) হলেও নিজ দেশে বিভেদ-বিভাজন ও বৈষম্যের শিকার জনগণের কণ্ঠরোধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও কোণঠাসা এমনকি গুম (আয়নাঘরে আটকিয়ে) হত্যার তৎপরতাই ছিল ‘স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি’র একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়াস। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাঠ-ঘাট পয়মাল করতেই এ বিভেদ-বিভাজন বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হয় ‘বাংলাদেশের জনগণ’, মহান মুক্তিযুদ্ধে যাদের ত্যাগ স্বীকারের স্বীকৃতি রয়েছে সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রারম্ভে। এ বিভেদ ও বিভাজনের, বৈষম্যের বেড়াজালে আটকানোর চেষ্টা চলে, রাজনীতি-দুর্বৃত্তায়ন-দলীয়করণের দ্বারা বিভেদ সৃষ্টি হয় রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভ- বিচার বিভাগ, সংসদ বা আইন বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের মধ্যে, এমনকি চতুর্থ স্তম্ভ মিডিয়ার মধ্যেও। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণের দ্বারা তারা সহজে সরকারের বশংবদ বাহকে পরিণত হয়-নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্নে ও প্রয়োজনে। এটির প্রেরণা চাণক্যের অর্থশাস্ত্র, জওহরলাল নেহরুর ডকট্রিনেরও।
একটি অপার সম্ভাবনাময় দেশ ও জাতির অগ্রগতি থামিয়ে দেওয়ার দীর্ঘমেয়াদে প্রকৃষ্ট কৌশল হচ্ছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বিপথে (ডিরেইলড) করে দেওয়া। পাবলিক মানি খরচ করে শিশু-কিশোরদের বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহের উদ্দেশ্যই হচ্ছে তাদের মুক্তবৃদ্ধি চর্চার, ইতিহাস সচেতনতা এবং মস্তিষ্ক প্রক্ষালনের প্রথমেই সুযোগ নেওয়া, দলকানা ও চেতনার ধ্বজাধারী লেখকদের রাজনৈতিক উৎকোচ দেওয়া আর মুদ্রণ ও সরবরাহ কাজে দুর্নীতি দুষ্কর্ম তো আছেই। দেশে দক্ষ জনবল না গড়ে বিদেশিদের এখানে নিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করা, দেশের বেসরকারি বিনিয়োগের পরিবেশ পয়মাল করে বিদেশি বিনিয়োগ আহ্বানের অভিনয় করা এবং বেসরকারি শিল্প খাতকে অচল করে, শিক্ষিত তরুণদের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি না করে, তাদের বেকার রেখে দেশ থেকে টাকা পাচার করে বিদেশে বিনিয়োগ করার গভীর ষড়যন্ত্রের কবলে বাংলাদেশের আর্থিক খাত, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থা। দেশ থেকে উদ্যোক্তারাও পাচার হচ্ছেন এবং বিদেশে শিক্ষিতরা দেশে ফিরতে উৎসাহ হারাচ্ছেন। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ন্যায়নীতি বোধ তিরোহিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যে নবজাগরণ প্রত্যক্ষ করা গেছে, তাতে অর্থ খাত, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় স্বনির্ভর হওয়ার প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।
সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি বিভেদ-বিভাজনের বেড়াজাল, যা সমতাভিত্তিক সমাজ ও সহজাত সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা। ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য, ব্যবধান বেড়েছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য সর্বত্র, সিন্ডিকেট এত শক্তিশালী যে তারা রাষ্ট্র ও সরকার সামলানোর ভূমিকায় অবতীর্ণ। রাষ্ট্রাচারে বিধিবিধান অনুসরণ যেহেতু দায়িত্ব ও কর্তব্যের পর্যায়ে পড়ে সেহেতু এ ব্যাপারে রাষ্ট্র্র ও নাগরিক উভয় পক্ষেরই পারস্পরিক সহযোগিতার ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ।
রাষ্ট্র নাগরিকের মানবিক মৌলিক অধিকার ও সেবার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ক্ষেত্রেই সৃষ্ট জটিলতা, অসম্পূর্ণতা, জবাবদিহি হীনতার পুরো পরিবেশটাকে ঢেলে সাজাতে প্রথমেই নির্বাচনব্যবস্থাকে সৎ স্বচ্ছ ও সাবলীল হওয়ার প্রসঙ্গ চলে আসবে। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য গঠিত সরকার নির্বাচিত হবে জনগণের দ্বারা এবং তারা পরিচালিত হবে জনগণের জন্য। রাষ্ট্রকে কর রাজস্ব প্রদান এড়িয়ে চলার বা ফাঁকিজুকি দিয়ে পার পাওয়ার প্রতিরোধাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ, করের টাকায় কেনা অস্ত্রের গুলিতে করদাতা কিংবা তার সন্তান হত্যা বন্ধ করা এবং করের টাকা দুর্নীতি দুর্বৃত্তপরায়ণের দ্বারা লোপাট না হতে দেওয়া, জবাবদিহিতার পরিবেশে নাগরিকের সব মৌলিক অধিকার ও দাবি পূরণে রাষ্ট্রের স্বচ্ছতাসুলভ আচরণ ও সেবা প্রাপ্তি সুনিশ্চিত হলেই বিভেদ-বিভাজন বৈষম্যের বেড়াজাল থেকে মুক্তি মিলবে।
লেখক : সাবেক সচিব ও এনবিআরের চেয়ারম্যান