ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ইসলামের প্রতিটি নির্দেশনা জীবনকে আলোকিত করে। সুখ-শান্তি আর সমৃদ্ধির পাথেয় জোগায়। ইসলাম ব্যক্তির জীবনকে যেমন সুখময় করে তোলে, তেমনি পরিবার সমাজ রাষ্ট্র তথা মানব জীবনের প্রতিটি স্তরে শান্তি-শৃঙ্খলার বার্তা নিয়ে আসে। একটি সুখময় উন্নত জীবনব্যবস্থা গড়ে তুলতে ইসলাম প্রদত্ত নির্দেশনাবলি অনুসরণের বিকল্প নেই। আমরা মানুষ। সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে আমাদের চলতে হয়। সমাজবিহীন একাকী বেঁচে থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। সমাজে অন্য দশজন মানুষের সঙ্গে মিলেমিশেই বয়ে চলে আমাদের জীবন। এ সমাজবদ্ধ যাপিত জীবনে পারস্পরিক সৌহার্দ্য সম্প্রীতির বিকল্প নেই। এ সৌহার্দ্য সম্প্রীতি বিনির্মাণে কালজয়ী জীবনাদর্শ ইসলামের রয়েছে অনন্য দিকনির্দেশনা। আর তা হচ্ছে ‘কথাবার্তায়, আচার আচরণে নম্রতা অবলম্বন করা’।
মানব সভ্যতার চিরকালীন মুক্তির মৌলিক পাথেয় আল কোরআনুল কারিম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনাদর্শ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সুন্নাহর পরতে পরতে রয়েছে যাপিত জীবনে বিনম্র আচরণের অনন্য শিক্ষা। যা একজন ব্যক্তির জীবনকে পরিশীলিত করে মার্জিত জীবনবোধে উদ্দীপ্ত করে। আল কোরআনুল কারিম শিক্ষা গ্রহণের এক অফুরন্ত ভান্ডার। কোরআন সব সময় উন্নত জীবনযাপনের নির্দেশনা দেয়। আর উন্নত জীবনযাপনে বিনম্র আচরণ একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘আর তোমরা মানুষের সঙ্গে উত্তমভাবে কথা বল’। (সুরা বাকারা- ৮৩)। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে- ‘নবী! আপনি আমার বান্দাদের বলুন, তারা যেন সর্বোত্তম পন্থায় কথাবার্তা বলে’। (সুরা বনি ইসরাইল-৫৩)।
কোনো অভাবগ্রস্ত মানুষ কোনো কিছু চাইলে মানবিকতার দাবি তাকে যথাসম্ভব প্রার্থিত বস্তু দেওয়ার চেষ্টা করা। যদি দেওয়া সম্ভব না হয় তবে বিনম্র ভাষায় তার কাছে অপারগতা পেশ করা। এটাই কোরআনের দৃপ্ত নির্দেশনা। ইরশাদ হয়েছে- ‘তোমার পালনকর্তার করুণার প্রত্যাশায় অপেক্ষমাণ থাকাকালে যদি কোনো সময় তাদের বিমুখ করতে হয়, তখন তাদের সঙ্গে নম্রভাবে কথা বল।’ (বনি ইসরাইল-২৮)।
এখানে ‘করুণার প্রত্যাশায় অপেক্ষমাণ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে সম্পদহীন অবস্থায় আল্লাহর পক্ষ থেকে সম্পদ প্রাপ্তির অপেক্ষা করা। এ আয়াতটি নাজিলের প্রেক্ষাপট হচ্ছে- কয়েকজন সাহাবি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে গিয়ে সওয়ারি প্রার্থনা করলে রসুল উত্তর দিলেন, ‘আমার কাছে কোনো সওয়ারি নেই, যার ওপর তোমাদের সওয়ার করাতে পারি’ এতে সাহাবারা মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে চলে যান। তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। দাওয়াত ইলাল্লাহ তথা মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করতে নম্র ভাষা প্রয়োগের বিকল্প নেই। এতে করে দাওয়াতপ্রাপ্ত ব্যক্তির মাঝে সঠিক পথ গ্রহণের সম্ভাবনা তৈরি হয়। আল্লাহতায়ালা হজরত মুসা ও হারুন (আ.)-কে খোদাদ্রোহী ফেরাউনের কাছে দাওয়াত নিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে নম্র ভাষায় দাওয়াত প্রদানের নির্দেশনা দেন। ইরশাদ হয়েছে- ‘অতঃপর তোমরা (ভ্রাতৃদ্বয় মুসা-হারুন) তাকে (ফেরাউন) নম্র কথা বল, হয়তো সে চিন্তা-ভাবনা করবে অথবা ভীত হবে।’ (সুরা তোয়াহা-৪৪)। কেউ আপনার সঙ্গে রূঢ় আচরণ করল, আপনি তার সঙ্গে নম্র আচরণ করুন। রূঢ়তার বদলা দিন নম্রতার মাধ্যমে। দেখবেন সে রূঢ় আচরণকারী একসময় আপনার কাছে বন্ধুত্বের হাত বাড়াচ্ছে। পবিত্র কোরআনের নির্দেশনা কত চমৎকার দেখুন- ‘সমান নয় ভালো ও মন্দ। (মন্দ আচরণের) জবাবে তাই বলুন যা উৎকৃষ্ট। তখন দেখবেন আপনার সঙ্গে যে ব্যক্তির শত্রুতা রয়েছে, সে যেন অন্তরঙ্গ বন্ধু।’ (সুরা হামিম সাজদা-৩৪)। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুরো জীবনটা ছিল নম্রতার মূর্তপ্রতীক। জীবনজুড়ে তিনি কথায় আচরণে বিনম্র হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘একজন মুমিন কথাবার্তার মাধ্যমে কাউকে আঘাত দিতে পারে না। অভিসম্পাত করতে পারে না। অশ্লীল ও খারাপ কথা বলতে পারে না।’ (মুসলিম : ২/৩৪২)। আল্লাহতায়ালা নম্রতা ও কোমলতাকে ভীষণ পছন্দ করেন। তিনি চান তার প্রতিটি বান্দা যেন কোমল ও বিনম্র হয়। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা কোমল ও নম্র। তিনি কোমলতা ও নম্রতা ভালোবাসেন।’ (মুসলিম : ২/৩২২)।
নম্রতা পুরোটাই সৌন্দর্যের প্রতীক। জীবনজুড়ে সৌন্দর্যের ফল্গুধারা বইয়ে দেয় এ নম্রতা। পক্ষান্তরে রূঢ়তা সবকিছুকেই বিস্বাদ করে দেয়। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত চমৎকার বলেছেন- ‘যে জিনিসে কোমলতা ও নম্রতা থাকে, সেটাই তার সৌন্দর্য বৃদ্ধির কারণ হয়। আর যে জিনিস কোমলতা ও নম্রতামুক্ত হয়, তা ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ (মেশকাত, পৃষ্ঠা : ৪৩১)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, আমরা এক দিন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বসা ছিলাম। এমতাবস্থায় নবীজি বললেন, আমি কি তোমাদের জানিয়ে দেব যে, কোন ব্যক্তির ওপর জাহান্নাম হারাম হয়ে যায়? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, অবশ্যই বলুন। তখন নবীজি বলেন, প্রত্যেক নম্র সহজ সরল সুন্দর আচরণের অধিকারী ব্যক্তির ওপর জাহান্নাম হারাম হয়ে যায়। (জামে তিরমিজি- ২৪৮৮)।
লেখক : খতিব, আউচপাড়া জামে মসজিদ টঙ্গী, গাজীপুর