দুনিয়া-আখেরাতে সফলতা লাভের মূলমন্ত্র হলো তওবা। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ওহে তোমরা যারা ইমান এনেছো! সবাই মিলে আল্লাহর কাছে তওবা করো। আশা করা যায়, তওবার মাধ্যমে দুনিয়া-আখেরাতে তোমরা সফল হবে।’ (সুরা নূর, আয়াত ৩১)। আরবি তওবা শব্দের অর্থ ফিরে আসা। আল্লাহর প্রেমের কোল ছেড়ে বান্দা যখন দুনিয়ার জীবনে ডুবে থাকে তখন প্রতিমুহূর্তে আল্লাহতায়ালা বান্দাকে ডাকতে থাকে। বান্দার কলবে গুনাহের প্রলেপ থাকায় আল্লাহর সে ডাক বান্দা শুনতে পায় না। হঠাৎ কোনো অলি-বুজুর্গের নেক সোহবতে বান্দার ভিতর যখন আল্লাহ-প্রেমের কথা মনে পড়ে যায় তখন রহমতের জোশ কলবে ঢেউ খেলে, বান্দা তখন আবার আল্লাহর কাছে ফিরে আসে। জ্ঞানীরা বলেন, গুনাহের জীবন থেকে আল্লাহর কোলে ফিরে আসার জন্য অর্থাৎ তওবা করার জন্য তিনটি বিষয় জরুরি। প্রথমত, বান্দাকে গুনাহর কাজটি ছেড়ে দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, গুনাহর জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হতে হবে। তৃতীয়ত, আর কখনো এমন গুনাহ করব না এ শপথ নিতে হবে। ইবলিশ যখন প্রথম আল্লাহর অবাধ্য হলো তখন সে এ তিনটির একটিও করেনি। ফলে তার আর আল্লাহর কোলে ফিরে আসা হয়নি। ইবলিশ প্রথমে সেজদা দিতে অস্বীকার করেছে। সে এ গুনাহর ওপরই জেদ ধরে বসে রইল। শুধু তাই নয়, সে তার গুনাহের জন্য অনুতপ্ত হওয়ার পরিবর্তে যুক্তি দাঁড় করাল। তার যুক্তিও আরেকটি গুনাহ তথা অহংকারে পূর্ণ ছিল। সে শপথ নিয়েছে ভবিষ্যতে আদম সন্তানকেও গুনাহতে ডুবিয়ে মারবে। তওবা কবুলে যে তিনটি শর্ত ওলামায়ে কেরাম বলেছেন সবগুলোই ইবলিশ ভঙ্গ করে চূড়ান্ত পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। মানুষকে তওবার দিকে আহ্বান করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ওহে তোমরা যারা ইমান এনেছো! তোমরা আল্লাহর কাছে খাঁটি তওবা করো।’ (সুরা তাহিরম, আয়াত ৮)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর কাছে মাফ চাও; তার কাছে তওবা করো।’ (সুরা হুদ, আয়াত ৩১)। তওবা কেন করতে হবে বা কীভাবে করতে হবে? দিনে কতবার তওবা করতে হবে এ সম্পর্কে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) একটি চমৎকার হাদিস বর্ণনা করেছেন। রসুল (সা.) বলেন, ‘আবু হুরায়রা আমার উম্মতকে জানিয়ে দিও, আমি দিনে সত্তরবারের বেশি তওবা করি এবং আল্লাহর কাছে মাফ চাই।’ (বুখারি)। অন্য বর্ণনায় হজরত আগার ইবনে ইয়াসার মুজান্নি (রা.) বলেন, ‘রসুল (সা.) বলেছেন, হে উম্মতেরা! তোমরা আল্লাহর কাছে মাফ চাও এবং তওবা করো। আমি প্রতিদিন ১০০ বার তওবা করি।’ (মুসলিম)। রসুলের খাদেম আবু হামজা আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাঁর বান্দার তওবায় সে ব্যক্তির চেয়েও বেশি খুশি হন যার উট গভীর মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়ার পর আবার সে তা ফিরে পায়।’ (বুখারি ও মুসলিম)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘আল্লাহ বান্দার তওবায় সে ব্যক্তির চেয়ে বেশি খুশি হন, যার উট খাবার ও পানীয় নিয়ে গভীর মরুভূমিতে হারিয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর হতাশ হয়ে সে একটি গাছের নিচে শুয়ে পড়ে। হঠাৎ চোখ খুলে সে দেখে উটটি ফিরে এসেছে। খুশিতে সে বলে ফেলে, আল্লাহ তুমি আমার বান্দা, আমি তোমার প্রভু। খুশির কারণে সে উল্টো বলে ফেলে। আল্লাহও তাঁর হারানো বান্দাকে ফিরে পেয়ে এর চেয়ে বেশি খুশি হন। (মুসলিম)। এতক্ষণ আলোচনা হয়েছে আল্লাহর হক লঙ্ঘন থেকে তওবা সম্পর্কে। কিন্তু কেউ যদি বান্দার কোনো হক নষ্ট করে তাহলে তিনটি শর্তের সঙ্গে আরও কিছু আনুষঙ্গিক শর্ত যোগ করতে হবে। প্রথম শর্ত হলো- সে যে হক নষ্ট করেছে তা ফিরিয়ে দিতে হবে। কারও জমি বা টাকা যদি জোর করে দখল করা হয়, তবে মালিককে খুঁজে ওই জমি বা টাকা বুঝিয়ে দিতে হবে। কাউকে অপবাদ দিয়ে যদি গুনাহ করা হয় তাহলে শরিয়তে বর্ণিত অপবাদের শাস্তি নিয়ে তারপর ওই ব্যক্তির কাছে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। কারও গিবত করা হলেও এজন্য যার গিবত করা হয়েছে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। তাহলেই সত্যিকারের তওবা হবে। শেষ করছি তওবা সম্পর্কে সবচেয়ে আশাপ্রদ হাদিস শুনিয়ে। হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামত না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ ক্ষমার হাত বাড়িয়ে বান্দাকে ডাকতে থাকেন। প্রতিদিন রাতে তিনি বান্দাকে ডেকে বলেন, কোথায় তারা, যারা দিনে গুনাহ করেছো, আসো তোমাদের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। আবার সকালে আল্লাহ রাতের গুনাহগারদের ডেকে বলেন, কোথায় আছো, যারা রাতে জুলুম করেছে, আসো তোমাদের ক্ষমা করে দেব।’ সুবহানাল্লাহ। (মুসলিম)। অন্য হাদিসে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের আগ পর্যন্ত আল্লাহ বান্দার তওবা কবুল করবেন।’ (মুসলিম)।
♦ লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর