‘একাত্তরের মা জননী, কোথায় তোমার মুক্তি সেনার দল’- এটি ঢাকাই সিনেমা ‘বিক্ষোভ’-এর গান। শুধু গান নয়, ঢাকাই সিনেমার গল্পেও উঠে এসেছে রাজনৈতিক প্রতিবাদ। এসব গান ও গল্প অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণা জোগায়। তেমনি কয়েকটি প্রতিবাদী গল্পের সিনেমার নায়কদের কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
রাজ্জাক [আলোর মিছিল, ১৯৭৪]
একাত্তরে বিজয়ের পরে এই দেশে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সূচনা হয়। সেই সময় কিছু মুনাফালোভী মানুষ খাদ্য মজুত করে নিজেদের পকেট ভারী করার জন্য। না খেয়ে থাকা মানুষের কষ্ট তাদের কাছে ডাল-ভাতের মতো ছিল, ‘মরলে মরুক! আমার কী। আমার টাকা আসলেই হবে!’ এ ধরনের চিন্তাধারা ছিল তাদের। এই চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছেন খলিল। আর এই মজুতদারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন আহত মুক্তিযোদ্ধা নায়করাজ রাজ্জাক। আলোর মিছিল মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালের ২৫ জানুয়ারি। বিখ্যাত এই চলচ্চিত্রটির পরিচালক ছিলেন নারায়ণ ঘোষ মিতা।
ফারুক [নয়নমনি, ১৯৭৬]
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন নির্মিত নয়নমনি চলচ্চিত্রটিকে তিনি করে তুললেন সমাজ বদলের হাতিয়ার। বিদ্রোহের এক ক্যানভাস। নিজের রচিত সুসাহিত্য ‘নিরক্ষর স্বর্গে’ কাহিনি অবলম্বনে তাঁর এ চলচ্চিত্র। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বাংলাদেশের কিংবদন্তি এ পরিচালকের দার্শনিক, সমাজ ভাবনার প্রতিফলন শুধু নয়, গোটা চলচ্চিত্রের পরতে পরতে শৈল্পিক নিপুণ বুননের প্রতিচ্ছবি রয়েছে। অন্ধকারে নিমজ্জিত সমাজের কুসংস্কার, ধর্মীয় মৌলবাদ এবং চিরাচরিত আগ্রাসি প্রভুত্ববাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামী মানুষের লড়াই করে টিকে থাকার ইতিহাসকে শিল্পায়িত করা হয়েছে এখানে। নয়নরূপী বলিষ্ঠ অভিনেতা ফারুক এ প্রতিবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তিনি গ্রাম্য মোড়লের অন্যায় রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। নয়নমনি মুক্তি পায় ১৯৭৬ সালের ২৬ জুন।
সালমান শাহ [বিক্ষোভ, ১৯৯৪]
মহম্মদ হান্নান পরিচালিত ছাত্র আন্দোলন নিয়ে আরও একটি সুপারহিট ছবি। এই ছবিতে ছাত্ররাজনীতির পুরো বিষয়টি গুছিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন পরিচালক। কীভাবে ছাত্ররাজনীতি শুরু হয়, কীভাবে আধিপত্য তৈরি হয়, কীভাবে অসৎ নেতারা কলেজ ক্যাম্পাসে নিজেদের ক্যাডারকে পোষেণ, কীভাবে সাধারণ ছাত্ররা অসৎ নেতাদের টার্গেটে পরিণত হয়, কীভাবে সাধারণ ছাত্রবিপ্লবী হয়ে ওঠে- এসব বিষয় মূল থেকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন গল্পকার। আর এ ছবির মহত্ত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন অমর নায়ক সালমান শাহ। তাঁর সঙ্গে ছিলেন নায়িকা শাবনূর। বিশেষ করে ছবির দুটি গান, ‘একাত্তরের মা জননী’ ও ‘বিদ্যালয় মোদের বিদ্যালয়’ ছাত্রদের মধ্যে ন্যায়ের জন্য বিপ্লব তৈরি করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
মান্না [ত্রাস, ১৯৯২]
কাজী হায়াৎ পরিচালিত ছাত্র আন্দোলন নিয়ে আলোচিত একটি ছবি ‘ত্রাস’। এ ছবিতেও অভিনয় করেছেন প্রয়াত মান্না। ছবির গল্পে দেখা যায়, কলেজ ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক দলের প্রভাব খাটানো বখাটে ছাত্রদের আধিপত্যে সাধারণ ছাত্ররা অসহায় হয়ে পড়ছে। কলেজের
ছাত্রী নায়িকা কবিতাকে অসম্মান করে কাবিলা। ওই সময় মাঠে উপস্থিত থাকা মান্না সবার সামনেই কাবিলাকে শায়েস্তা করে। এর থেকে শুরু হয় একের পর এক রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। ‘একতা শান্তি শৃঙ্খলা’ গানের মাধ্যমে শান্তির পরিবেশ সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাইলেও সেটা ছাত্ররা পারে না। তাই দুর্নীতিগ্রস্ত অসৎ নেতা রাজীব, মিজু আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন মান্না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাকে বরণ করে নিতে হয় ছাত্ররাজনীতির করুণ বাস্তবতা।
শাকিব খান [লিডার আমিই বাংলাদেশ, ২০২৩]
একজন সচেতন যুবক যিনি সমাজকে দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে মুক্ত করার জন্য একটি রূপান্তরমূলক যাত্রা শুরু করেছিলেন, শহরের একটি এলাকায় ন্যূনতম নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নেই। কাউন্সিলর এবড়োখেবড়ো রাস্তা মেরামতের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণকে হতাশ করেছেন। এলাকার এক যুবক নাফিস ইকবাল (শাকিব খান) চাকরি ছেড়ে দিয়ে এলাকায় একটি কফি শপ চালান। তিনি মনে করেন, যুবকরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, তাদের উচিত সরকারের দিকে না তাকিয়ে নিজেদের কাজ করা। এভাবে একসময় দুর্নীতিবাজ সমাজপতিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন শাকিব খান। চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন তপু খান। এটি মুক্তি পায় ২০২৩ সালের ২২ এপ্রিল।
অমিত হাসান [চেতনা, ১৯৯০]
ছটকু আহমেদ পরিচালিত ছবি ‘চেতনা’। এ ছবির গল্পে দেখা যায়, শিক্ষক আলমগীরকে তার ছাত্ররা মনে-প্রাণে ভালোবাসে। ছাত্রদের মধ্যে নায়ক হিসেবে ছিলেন অমিত হাসান। তার সঙ্গে ছিলেন মিশা সওদাগরও। এক সময় আলমগীর খুন হন প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসী এ টি এম শামসুজ্জামানের হাতে। প্রিয় শিক্ষকের মৃত্যুর খবর শুনে আন্দোলন শুরু করে ছাত্ররা। বিশেষ করে এ টি এমের আধিপত্যের এলাকাকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে প্রতিশোধ নেওয়া শুরু করে অমিত, মিশাসহ অন্য ছাত্ররা। শুরু হয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের লড়াই। ন্যায়ের পক্ষে লড়াই করা অভিনেতারা এ ছবির মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছেন ভবিষ্যতে অর্থাৎ বাস্তবে ছাত্রদের করণীয় কী?
ওমর সানী [অধিকার চাই, ১৯৯৮]
ওয়াকিল আহমেদ পরিচালিত ছবি ‘অধিকার চাই’। ছাত্ররাজনীতি নিয়ে নির্মিত এ ছবিতেও অভিনয় করেছেন ওমর সানী। এর গল্পে দেখা যায়, ওমর সানী সাধারণ ও বোকা হলেও ক্লাসে মনোযোগী ছাত্র। কলেজের ছাত্রী শাবনূরের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও প্রেম। একই কলেজের বখাটে ছাত্র মিশা সওদাগর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থে ওমর সানীর বাবা বুলবুল আহমেদ ও শাবনূরের বোনকে হত্যা করে। সইতে না পেরে এই বোকাসোকা ছাত্র ওমর সানী প্রতিবাদী হয়ে কলেজ ক্যাম্পাসেই মিশাকে খুন করে। কিন্তু সমাজের মন্দ লোক হুমায়ুন ফরীদির আধিপত্যের শিকার হয় সানী ও শাবনূর। তারপরও লড়তে থাকেন সাধারণ ছাত্রের অধিকার আদায়ের জন্য।
কাজী মারুফ [ইতিহাস, ২০০২]
কাজী হায়াতের আরেক সফল ছবি ‘ইতিহাস’। ছবির নায়ক কাজী হায়াতেরই ছেলে কাজী মারুফ। এর গল্পে দেখা যায়, ‘কলেজের সাধারণ ছাত্র কাজী মারুফ। যে কোনো এক ঘটনায় দুর্নীতিগ্রস্ত এক অসৎ পুলিশের সঙ্গে তাকে মিশতে হয়। পরিস্থিতির শিকার হয়ে সেই পুলিশ অফিসারের কারণে স্বাভাবিক জীবন হারায় মারুফ।
জড়িয়ে পড়েন সন্ত্রাসের সঙ্গে। কিন্তু সন্ত্রাসী হয়ে নিজেই দমন করতে থাকেন সব দুষ্টকে। কাজী হায়াতের এ ছবিটিও ছাত্ররাজনীতির শিকার হওয়ার এক ছাত্রের আত্মত্যাগ বলা যায়।
সম্রাট [আমি বাঁচতে চাই, ২০০৭]
নায়করাজ রাজ্জাক পরিচালিত একটি আলোচিত ছবি ‘আমি বাঁচতে চাই’। পুরোপুরি ছাত্র আন্দোলন না হলেও সাধারণ ছাত্র থেকে কীভাবে পরিস্থিতির শিকার হয়ে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে তারই গল্প এ ছবি। তবে ছবিটি পুরোপুরি রাজনৈতিক। এ ছবিতে অভিনয় করেছেন রাজ্জাক তনয় সম্রাট। নায়িকা ছিলেন জনা ও অপু বিশ্বাস। এর গল্পে দেখা যায়, মফস্বল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে ছাত্রনেতাদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড দেখে মেজাজ খারাপ হয় সম্রাটের। মাদকদ্রব্যের কারণে এক সাধারণ ছাত্রকে ছাত্রনেতাদের মারার বিষয়টিও সে মেনে নিতে পারে না। প্রতিবাদ করে সে। এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায়। একদিন বোমা হামলার মিথ্যা অভিযোগে সম্রাটকে পুলিশ নির্যাতন করে। একসময় রাজনীতির প্রতি একরাশ ঘৃণা নিয়ে পড়াশোনা বাদ দিয়ে বাড়ি ফিরে যায় সম্রাট। কিন্তু রাজনীতি তাকে আর ছাড়ে না। স্থানীয় নোংরা রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় সাধারণ ছাত্র সম্রাট।