‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ, তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।’ আব্বাসউদ্দীনের চোখ পানিতে ছলছল করছে। একটা গানের জন্য কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাঁকে। সেই গানটি এখন তাঁর হাতের মুঠোয়...
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের গানের ভান্ডার বিশাল। তাঁর লেখা গানের ভান্ডারে ধর্মীয়, প্রেম-ভালোবাসা, দ্রোহ ছাড়াও ভক্তিরসের সংগীতের স্রোতধারা সমুজ্জ্বলভাবে বহমান। তিনি ভক্তিমূলক গানের মধ্যে হিন্দুধর্মের ৩ হাজারেরও বেশি গান রচনা করেছেন। নজরুল ভক্তিমূলক গানের মধ্যে হিন্দুধর্মের শ্রীকৃষ্ণ-রাধার লীলা কীর্তন, বৈষ্ণবপদাবলি, শ্যামা সংগীত ও অন্যান্য ভক্তিগীতি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে। আবার পল্লীগীতি ও ভাওয়াইয়া শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের অনুরোধে নজরুল ইসলাম হামদ-নাত আঙ্গিকের ইসলামি গান রচনা করেন। নজরুল ইসলামের লেখা হিন্দুধর্মের ভক্তি সংগীতগুলো কতটা জনপ্রিয় তা কয়েকটি গানের কথা উল্লেখ করলেই বোঝা যায়। যেমন- হে গোবিন্দ রাখ চরণে, সখী সে হরি কেমন বল, নীল যমুনার জল, গোঠের রাখাল, বলে দে রে কোথায় বৃন্দাবন, জাগো জাগো শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী, কৃষ্ণ কোথায় বল, মম মধুর মিনতি শোন ঘনশ্যাম গিরিধারী ইত্যাদি রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক নজরুল ইসলামের লেখা রসসিক্ত ভক্তিগীতি। এ ছাড়াও কাজী নজরুল জনপ্রিয় ভক্তিমূলক যেসব শ্যামাসংগীত রচনা করেছেন তার অধিকাংশই ভক্তদের মনে রেখাপাত করেছে। তাঁর লেখা সেই সমস্ত শ্যামাসংগীতের মধ্যে রয়েছে- ‘আমার কালো মেয়ে পালিয়ে বেড়ায় কে দেবে তায় ধরে, মা আছে রে সকল নামে, মা যে গোপাল-সুন্দরী, আমি মা বলে যত ডেকেছি, আমি সাধ করে মোর গৌরী মেয়ের নাম রেখেছি কালী প্রভৃতি। নজরুল ইসলাম ভাওয়াইয়া গানের গীতিকার ও গায়ক আব্বাসউদ্দীনের অনুরোধে প্রথম ইসলামি গান লিখে কলকাতার গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে রেকর্ড করান। এ গানটি ছিল, ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’ এ গানটি কতটা শ্রোতাপ্রিয়তা লাভ করেছে তা বলে শেষ করার নয়। তারপর তিনি যেসব ইসলামি গান, হামদ, নাত, গজল রচনা করেন, তার সবই ছিল ভক্তির রসে সিক্ত। খোদা এই গরিবের শোন শোন মোনাজাত, ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলোরে দুনিয়ায়, তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে, মধু পূর্ণিমার সেথা চাঁদ দোলে প্রভৃতি আজও শ্রোতাদের মনে ভাব জাগানিয়া হয়ে আছে। ১৯৩০ সাল, এই দশকের শুরুতেই তাঁর ‘চন্দ্রবিন্দু’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এতে থাকা ৪৩টি গানকে এককথায় বলা যায় ধর্মীয় সংগীত। বিষয়বস্তু অনুযায়ী এ গানগুলোকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। যেমন এতে বেশ কয়েকটি গান আছে, যা সব ধর্মের জন্য গ্রহণযোগ্য। তা ছাড়া কতগুলো গান আছে যা বৈষ্ণবদের উপযোগী, কতগুলো বিভিন্ন হিন্দু দেব-দেবীর প্রতি নিবেদিত, বিশেষ করে কালীর প্রতি নিবেদিত শ্যামাসংগীত। এমনকি আছে তাঁর বিখ্যাত ইসলামি গান ‘বক্ষে আমার কাবার ছবি, চক্ষে মোহাম্মদ রসুল’ এবং আরও একটি ইসলামি গান। পরে শতাধিক ইসলামি গান রচনা করেন তিনি। ১৯৩১ সালে নজরুল পেশা হিসেবেই গান রচনাকে বেছে নেন এবং গ্রামোফোন কোম্পানির জন্য গান লিখতে শুরু করেন। নিজের অন্তরের তাগিদে, বাণিজ্যিক কারণে তিনি শত শত ধর্মীয় গান রচনা করেন। যার বেশির ভাগই হিন্দুধর্মের বিভিন্ন শাখার উপযোগী। বিশেষ করে তাঁর শ্যামাসংগীতের জন্য তিনি বিখ্যাত হন। একবার শ্যামাসংগীতের রেকর্ডিং শেষে কাজী নজরুল ইসলাম বাড়ি ফিরছেন। যাত্রাপথে তাঁর পথ আগলে ধরেন সুরসম্রাট আব্বাসউদ্দীন। একটা আবদার নিয়ে এসেছেন তিনি। আবদারটি না শোনা পর্যন্ত নজরুলকে তিনি এগোতে দেবেন না। আব্বাসউদ্দীন নজরুলকে সম্মান করেন, সমীহ করে চলেন। নজরুলকে তিনি ‘কাজীদা’ বলে ডাকেন। নজরুল বললেন, ‘বলে ফেলো তোমার আবদার।’ আব্বাসউদ্দীন সুযোগটা পেয়ে গেলেন। বললেন, ‘কাজীদা, একটা কথা আপনাকে বলব বলব ভাবছি। দেখুন না, পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়াল এরা কী সুন্দর উর্দু কাওয়ালি গায়। শুনেছি এদের গান অসম্ভব রকমের বিক্রি হয়। বাংলায় ইসলামি গান তো তেমন নেই। বাংলায় ইসলামি গান গেলে হয় না? আপনি যদি ইসলামি গান লেখেন, তাহলে মুসলমানদের ঘরে ঘরে আপনার জয়গান হবে।’ বাজারে তখন ট্রেন্ড চলছিল শ্যামাসংগীতের। শ্যামাসংগীত গেয়ে সবাই রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছে। এই স্রোতে গা ভাসাতে গিয়ে অনেক মুসলিম শিল্পী হিন্দু নাম ধারণ করেন। মুনশী মোহাম্মদ কাসেম হয়ে যান ‘কে. মল্লিক’, তালাত মাহমুদ হয়ে যান ‘তপন কুমার’। মুসলিম নামে হিন্দু সংগীত গাইলে গান চলবে না। নজরুল নিজেও শ্যামাসংগীত লেখেন, সুর দেন। গানের বাজারের যখন এ অবস্থা তখন আব্বাসউদ্দীনের এমন আবদারের জবাবে নজরুল কী উত্তর দেবেন? ‘ইসলাম’ শব্দটার সঙ্গে তো তাঁর কত আবেগ মিশে আছে। ছোটবেলায় মক্তবে পড়েছেন, কোরআন শিখেছেন, এমনকি তাঁর নিজের নামের সঙ্গেও তো ‘ইসলাম’ আছে। আব্বাসউদ্দীনকে তো এই মুহূর্তে সরাসরি ‘হ্যাঁ’ বলা যাচ্ছে না। স্রোতের বিপরীতে সুর মেলানো চাট্টিখানি কথা নয়। আবেগে গা ভাসালে চলবে না। গান রেকর্ড করতে হলে তো বিনিয়োগ করতে হবে, সরঞ্জাম লাগবে। এগুলোর জন্য আবার ভগবতী বাবুর কাছে যেতে হবে। ভগবতী বাবু হলেন গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল ইনচার্জ। নজরুল বললেন, ‘আগে দেখো ভগবতী বাবুকে রাজি করাতে পারো কি না।’ আব্বাসউদ্দীন ভাবলেন, এইতো, কাজীদার কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেলাম, ভগবতী বাবুকে কীভাবে রাজি করাতে হয় সেটা এখন দেখবেন। ভগবতী বাবুর কাছে গিয়ে আব্বাসউদ্দীন অনুরোধ করলেন। কিন্তু ভগবতী বাবু ঝুঁকি নিতে রাজি নন। মার্কেট ট্রেন্ডের বাইরে গিয়ে বিনিয়োগ করলে ব্যবসায় লালবাতি জ্বলতে পারে। আব্বাসউদ্দীন যতই তাঁকে অনুরোধ করছেন, ততই তিনি বেঁকে বসছেন। ওইদিকে আব্বাসউদ্দীনও নাছোড়বান্দা। এত বড় সুরকার হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভগবতী বাবুর পিছু ছাড়ছেন না। অনুরোধ করেই যাচ্ছেন। দীর্ঘ ছয় মাস চলল অনুরোধ প্রয়াস। এ যেন পাথরে ফুল ফোটানোর আপ্রাণ চেষ্টা। এক দিন ভগবতী বাবুকে ফুরফুরে মেজাজে দেখে আব্বাসউদ্দীন বললেন, ‘একবার এক্সপেরিমেন্ট করে দেখুন না, যদি বিক্রি না হয় তাহলে আর নেবেন না। ক্ষতি কী?’ ভগবতী বাবু আর কত ‘না’ বলবেন। এবার হেসে বললেন, ‘নেহাতই নাছোড়বান্দা আপনি। আচ্ছা যান, করা যাবে। গান নিয়ে আসুন।’ আব্বাসউদ্দীনের খুশিতে চোখে পানি আসার উপক্রম। নজরুল চা আর পান পছন্দ করেন। এক ঠোঙা পান আর চা নিয়ে আব্বাসউদ্দীন নজরুলের রুমে গেলেন। পান মুখে নজরুল খাতা-কলম হাতে নিয়ে একটা রুমে ঢুকে পড়লেন। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আব্বাসউদ্দীন অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। টেনশনে পায়চারি করছেন। প্রায় আধা ঘণ্টা কেটে গেল। বন্ধ দরজা খুলে নজরুল বের হলেন। পানের পিক ফেলে আব্বাসউদ্দীনের হাতে একটা কাগজ দিলেন। এই কাগজ তাঁর আধা ঘণ্টার সাধনা। আব্বাসউদ্দীনের ছয় মাসের পরিশ্রমের ফল। আব্বাসউদ্দীন কাগজটি হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন : ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ, তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।’ আব্বাসউদ্দীনের চোখ পানিতে ছলছল করছে। একটা গানের জন্য কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাঁকে। সেই গানটি এখন তাঁর হাতের মুঠোয়। তিনি কি জানতেন, তাঁর হাতে বন্দি গানটি এক দিন বাংলার ইথারে ইথারে পৌঁছে যাবে? ঈদের চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে টিভিতে ভেজে উঠবে- ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে...?’ দুই মাস পর রোজার ঈদ। গান লেখার চার দিনের মধ্যে গানের রেকর্ডিং শুরু হয়ে গেল। আব্বাসউদ্দীন জীবনে এর আগে কখনো ইসলামি গান রেকর্ড করেননি। গানটি তাঁর মুখস্থও হয়নি এখনো। গানটা চলবে কি না এ নিয়ে গ্রামোফোন কোম্পানি শঙ্কায় আছে। তবে কাজী নজরুল ইসলাম বেশ এক্সাইটেড। কীভাবে সুর দিতে হবে দেখিয়ে দিলেন। হারমোনিয়ামের ওপর আব্বাসউদ্দীনের চোখ বরাবর কাগজটি ধরে রাখলেন নজরুল নিজেই। সুরসম্রাট আব্বাসউদ্দীনের বিখ্যাত কণ্ঠ থেকে বের হলো- ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ...’। রমজানের রোজার পর ঈদ এলো। আব্বাসউদ্দীন বাড়িতে ঈদ কাটালেন। কখন কলকাতায় যাবেন এই চিন্তায় তাঁর তর সইছে না। গানের কী অবস্থা তিনি জানেন না। তাড়াতাড়ি ছুটি কাটিয়ে কলকাতায় ফিরলেন। ঈদের ছুটির পর প্রথমবারের মতো অফিসে যাচ্ছেন। ট্রামে চড়ে অফিসের পথে যত এগোচ্ছেন, বুকটা তত ধক্ ধক্ করছে। আব্বাসউদ্দীন যখন চিন্তায় মগ্ন, তখন পাশে বসা এক যুবক গুনগুনিয়ে গাওয়া শুরু করল- ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। এই যুবক গানটি কোথায় শুনল? নাকি আব্বাসউদ্দীন ভুল শুনছেন? না তো। তিনি আবারও শুনলেন যুবকটি ওই গানই গাচ্ছে। এবার তাঁর মনের মধ্যে এক শীতল বাতাস বয়ে গেল। অফিস ফিরে বিকালে যখন গড়ের মাঠে গেলেন তখন আরেকটা দৃশ্য দেখে এবার দ্বিগুণ অবাক হলেন। কয়েকটা ছেলে দলবেঁধে মাঠে বসে আছে। তার মধ্য থেকে একটা ছেলে গেয়ে উঠল- ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। আব্বাসউদ্দীন এত আনন্দ একা সইতে পারলেন না। তাঁর সুখব্যথা হচ্ছে। ছুটে চললেন নজরুলের কাছে। গিয়ে দেখলেন নজরুল দাবা খেলছেন। আব্বাসউদ্দীনের গলার স্বর শোনার সঙ্গে সঙ্গে নজরুল দাবা খেলা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। নজরুল বললেন, ‘আব্বাস, তোমার গান কী যে হিট হয়েছে।’ অল্প কদিনের মধ্যেই গানটির হাজার হাজার রেকর্ড বিক্রি হয়। ভগবতী বাবুও দারুণ খুশি। একসময় তিনি ইসলামি সংগীতের প্রস্তাবে একবাক্যে ‘না’ বলে দিয়েছিলেন, আজ তিনিই নজরুল-আব্বাসকে বলছেন, ‘এবার আরও কয়েকটি ইসলামি গান গাও না’। শুরু হলো নজরুলের রচনায় আর আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে ইসলামি গানের জাগরণ। বাজারে এবার নতুন ট্রেন্ড শুরু হলো ইসলামি সংগীতের। এই ট্রেন্ড শুধু মুসলমানকেই স্পর্শ করেনি, স্পর্শ করেছে হিন্দু শিল্পীদেরও। একসময় মুসলিম শিল্পীরা শ্যামাসংগীত গাওয়ার জন্য নাম পরিবর্তন করে হিন্দু নাম রাখতেন। এবার হিন্দু শিল্পীরা ইসলামি সংগীত গাওয়ার জন্য মুসলিম নাম রাখা শুরু করলেন। তবে বিখ্যাত অনেক হিন্দু শিল্পী স্বনামেও নজরুলের ইসলামি সংগীত গেয়েছেন। যেমন- অজয় রায়, ড. অনুপ ঘোষাল, আশা ভোঁসলে, মনোময় ভট্টাচার্য, রাঘব চট্টোপাধ্যায়।