ব্যক্তিজীবনেও ছিলেন মাটির মানুষ। পরিবারের দায়বদ্ধতা, ওস্তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। গড়ে তুলেছিলেন ‘ওস্তাদ আবদুল আজিজ বাচ্চু স্মৃতি সংসদ’। জন্মস্থান কোটালীপাড়ায় গিয়েও তৈরি করেছিলেন উপাসনালয় ‘প্রার্থনা কুঞ্জ’। ২০১৯ সালে ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হন। এরপর বিদেশে চিকিৎসা নিয়েও ২০২০ সালের ৬ জুলাই না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি।
বাংলা গানের রাজপুত্র এন্ড্রু কিশোর। রাজশাহীর এক সাদামাটা পরিবারে জন্ম নেওয়া এ কিংবদন্তির সংগীতযাত্রা শুরু হয় মাত্র তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময়। শৈশবে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাওয়া শুরু। বড় বোন মার্সেলা শিখা বাড়ৈ বিশ্বাস গান শিখতেন, আর ভাই স্বপন বাড়ৈ বাজাতেন তবলা। সেই পরিবেশেই ছোট কিশোরের মনে বীজ বোনা হয় সংগীতের প্রতি ভালোবাসার। যখন ভাইবোন বরিশাল বোর্ডিং স্কুলে চলে যান, তখন ওস্তাদ আবদুল আজিজ বাচ্চু ছোট্ট কিশোরকেই নিজের শিষ্য করতে চান। আর মা-বাবা দুজনেই ছিলেন সংগীতের সমঝদার। তাই আর বেগ পেতে হয়নি, তার বাবা হাসিমুখে প্রতিদিন সাইকেলে করে ছেলেকে সুরবাণী সংগীত বিদ্যালয়ে ওস্তাদজির কাছে গান শেখাতে নিয়ে যাওয়ার কাজটা আগ্রহ নিয়েই করতে থাকেন। ১৯৬৪ সালে এভাবেই সংগীতের হাতেখড়ি হয় কিশোরের। ছোট্ট কিশোর এরপর মন দিয়ে শুধু দুটি জিনিসই করে গেছেন-লেখাপড়া আর সংগীতচর্চা।
অনার্সের শেষ বর্ষে মৌখিক পরীক্ষা নিতে ঢাকা থেকে এক অধ্যাপক গেলেন। কিশোরকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে রাজশাহী সিটি কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, ‘ও হচ্ছে আমাদের ছাত্র। সিনেমায় গান গায়।’ শুনে অধ্যাপক বললেন, ‘বাহ, তাহলে ও মাস্টার্সটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই করুক। তাহলে ওর গানের জন্যও সুবিধা হবে।’ শিক্ষক প্রস্তাব দিলেন, ভালো সুযোগ বলা যায়। তবে কাজে লাগানো গেল না তাঁর মায়ের জন্য। তাঁর মা সব সময় বলতেন, ‘মাস্টার্স শেষ করার আগে আমি তোকে ছাড়ছি না।’ ফলে মাস্টার্সের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হতে হয় তাঁকে। একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘শুধু একাডেমিক নয়, মনুষ্যত্বের শিক্ষাও মা শিখিয়েছেন। শিল্পী হতে হলেও এ শিক্ষা খুব দরকার।’ আর তাই হয়তো তিনি বলতেন, ‘আমি শিল্পী নই, আমি কণ্ঠশ্রমিক।’ বিনয় আর সততার এমন নজির খুব কমই দেখা যায়। ক্যারিয়ারের বিষয় নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে এন্ড্রু কিশোর বলেন, ‘জীবনে প্রথম গান গেয়ে ৮০০ টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছিলাম। তবে সেই টাকা হাতে পাইনি। স্কুলের এক বড় ভাই ঢাকা থেকে আসছিলেন। বলে দিলাম, তাঁর কাছে টাকাটা দিয়ে দিন। বন্ধুবান্ধব সবাই মিলে খাওয়াদাওয়া করে সে টাকা শেষ করে দিল।’ জেনেও তিনি কখনো কিছু বলেননি সেই বড় ভাই বা কাউকে; ভাবা যায় এমন বিনয়! ২০১৩ সালে বাংলাদেশ আইডল নামে একটি প্রতিযোগিতায় বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সেই প্রতিযোগিতারই একটি পর্বে তিনি বলেন, ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে গান গাইলেও এখনো নিজেকে কণ্ঠশিল্পী ভাবেন না তিনি, নিজেকে মনে করেন কণ্ঠশ্রমিক। তিনি বলেন, ‘শিল্পী অনেক বড় ব্যাপার। আমি কষ্ট করে গান গাই। চেষ্টা করি। আমি হচ্ছি শ্রমিক। কণ্ঠশ্রমিক! শিল্পের পর্যায়ে যেতে অনেক সাধনা করতে হবে!’ একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী কতটা বিনয়ী হলে প্রকাশ্যে এমন কথাগুলো বলতে পারেন!
গানের ভুবনে তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্লেব্যাকের সম্রাট। অজস্র জনপ্রিয় গান উপহার দিয়ে মুগ্ধ করেছেন কয়েক প্রজন্ম। তাঁর কণ্ঠের জাদুতে প্রাণ পেত রোমান্টিক থেকে দেশপ্রেম-সব ধরনের গানই। একজন সত্যিকারের ‘কমন সিঙ্গার’ হয়ে উঠেছিলেন তিনি, যাঁর গলা সবার সঙ্গেই মানিয়ে যেত অনায়াসে। প্রায় ১৫ হাজার গানে কণ্ঠ দেওয়া শিল্পী এন্ড্রু কিশোর।
ব্যক্তিজীবনেও ছিলেন মাটির মানুষ। পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধ, ওস্তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। গড়ে তুলেছিলেন ‘ওস্তাদ আবদুল আজিজ বাচ্চু স্মৃতি সংসদ’। জন্মভূমি কোটালীপাড়ায় গিয়েও তৈরি করেছিলেন উপাসনালয় ‘প্রার্থনা কুঞ্জ’। ২০১৯ সালে ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হন। এরপর বিদেশে চিকিৎসা নিয়েও ২০২০ সালের ৬ জুলাই না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি।
এন্ড্রু কিশোর নেই, কিন্তু থেকে গেছে তাঁর কণ্ঠ, যা বাংলার প্রতিটি হৃদয়ে বাজে অমলিন সুর হয়ে।