নব্বই দশকের শেষ ভাগে শুরু হওয়া খরা কাটিয়ে গত বছর আলোর মুখ দেখতে শুরু করে ঢালিউডের চলচ্চিত্র। বেশ কয়েকটি মানসম্মত চলচ্চিত্র পেয়ে সিনেমা হলে ফিরতে শুরু করে মধ্যবিত্তসহ সব শ্রেণির দর্শক। এতে প্রেক্ষাগৃহ মালিকরাও উৎসাহ এবং আগ্রহ ফিরে পান। খুলতে শুরু করে বন্ধ সিনেমা হল। কিন্তু চলতি বছর আবারও অন্ধকারের কালো ছায়া পড়ে চলচ্চিত্র শিল্পের ওপর। এতে হতাশ চলচ্চিত্রকার, প্রদর্শক ও দর্শক। চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির দেওয়া তথ্যমতে, চলতি বছরের গত শুক্রবার পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছে ২২টি চলচ্চিত্র। এগুলো হচ্ছে- দাবাং, দাগ এই বুকের ভেতর, কি দারুণ দেখতে, মনের মধ্যে লেখা, তোমার কাছে ঋণী, লোভে পাপ পাপে মৃত্যু, অগি্ন, লাট্টু কসাই, কুসুমপুরের গল্প, সীমারেখা, খাঁচার পাখি, রাজত্ব, অনন্তকালের ভালোবাসা, তোকে ভালোবাসতেই হবে, ১ নম্বর আসামি, বৈষম্য, '৭১-এর সংগ্রাম, দবির সাহেবের সংসার, ডেয়ারিং লাভার, জোনাকির আলো, অন্ধ নিরাঙ্গম এবং মায়ের মমতা। প্রদর্শক সমিতি ও সিনেমা হল মালিকদের মতে, এর মধ্যে মোটামুটি ব্যবসা করেছে লোভে পাপ পাপে মৃত্যু, অগি্ন, তোকে ভালোবাসতেই হবে। মানে মাত্র তিনটি চলচ্চিত্র। আর গত শুক্রবার ৪২টি হলে মুক্তি পাওয়া 'মায়ের মমতা' এখন পর্যন্ত আশা জাগিয়ে রেখেছে। হল মালিকরা বলছেন, প্রচণ্ড গরমের কারণে আশানুরূপ দর্শক সাড়া মিলছে না। তবে যারা দেখেছে তারা মোটামুটি প্রশংসা করছে ছবিটির।
হঠাৎ চলচ্চিত্র ব্যবসায় ধস নামার কারণ সম্পর্কে নায়করাজ রাজ্জাক বলেন, এখন মানসম্মত নির্মাতা, গল্প ও চিত্রনাট্যের বড়ই অভাব। নকল গল্প, দুর্বল চিত্রনাট্য ও গতিহীন নির্মাণের চলচ্চিত্র দর্শক কীভাবে গ্রহণ করবে। ফলে বর্তমান সময়ের চলচ্চিত্র কৌলিন্য ও দর্শক গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আজিজুর রহমান বলেন, ভালো গল্প ও নির্মাতা তো নেই। তার ওপর ডিজিটালের নামে স্বল্প খরচে টেলিফিল্মের আদলে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে দর্শকদের বোকা বানানোর চেষ্টা চলছে। যারা এ কাজ করছে তারা আসলে নিজেরাই বোকার স্বর্গে বসবাস করছে। কারণ উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির যুগে দর্শক ঠকানোর কোনো উপায় নেই। বিশিষ্ট নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম বলেন, শুধু প্রযুক্তিগত গ্লামার দিয়ে দর্শক মন জয় করা যায় না। গল্প, নির্মাণ ও অভিনয়ে জোর থাকতে হবে। যা এখন নেই। ফলে যা হওয়া স্বাভাবিক তাই হচ্ছে। চলচ্চিত্রের ব্যবসা বরাবরই নিম্নগামী হচ্ছে। বর্তমান প্রজন্মের নির্মাতা স্বপন আহমেদ বলেন, বর্তমানে নির্মাতাদের মধ্যে নকল প্রবণতা জেঁকে বসেছে। আগে ধ্যান-ধারণা ছিল শিল্পমুখী আর এখন অতিমাত্রায় বাণিজ্যিক। ফলে দর্শক বড়পর্দায় জীবনের প্রতিচ্ছবি আর স্বপ্নের বাস্তবায়ন না পেয়ে হতাশ হচ্ছে। আনন্দ-ছন্দ প্রেক্ষাগৃহের ব্যবস্থাপক শামসুল আলম বলেন, দেশে পানির কোনো অভাব নেই, কিন্তু খাবার পানির বড়ই অভাব। ঠিক তেমনি আমাদের দেশে ছবিরও অভাব নেই। কিন্তু সত্যিকারের ছবি কোথায়। মানসম্মত ছবির অভাবে দর্শকশূন্য প্রেক্ষাগৃহ চালাতে গিয়ে চরম লোকসান গুনতে হচ্ছে। এভাবে প্রেক্ষাগৃহের ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যায় না। প্রদর্শক সমিতির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একসময় চলচ্চিত্রের পৃষ্ঠপোষকতা করত নবাব আর জমিদার শ্রেণি। আর এখন তা চলে গেছে কারওয়ান বাজারের মুদির দোকানদার ও সিটি করপোরেশনের ঠিকাদারদের হাতে। চলচ্চিত্র হচ্ছে বোদ্ধা শ্রেণির গবেষণার ফসল ও স্পর্শকাতর বিষয়। কারণ এটি হচ্ছে প্রধান গণমাধ্যম। দেশ ও জাতির জীবন-সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি চলচ্চিত্রে ফুটে ওঠে। তাই এই মাধ্যমটি যখন অশিক্ষিত এবং নিম্নরুচির মানুষের হাতে চলে গেছে তখন তো এটি সস্তা ও অরুচিকর পণ্য ছাড়া আর কিছুই নয়।