ছেলে হয়ে জন্মেছিলেন। কিন্তু মেয়েদের সঙ্গেই বন্ধুত্ব হতো। ছিলেন মায়ের খুব ঘনিষ্ঠ। কিছুটা মেয়েলি স্বভাবের হওয়ায় আচার-আচরণ নিয়ে প্রায়ই কথা উঠতো। এক সময় সিন্ধান্ত নেন অপারেশন করে লিঙ্গ পরিবর্তন করে ফেলবেন। পরিবারের অমত থাকলেও নিজের সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করেন। এরপর মডেলিংয়ের পেছনে দৌঁড়াতে থাকেন। বার বার ব্যর্থ হন। কিন্তু ভেঙে পড়েননি। সমাজের নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে এখন তিনি সফল মডেল। ভারতীয় ফ্যাসন উইকে এই প্রথম র্যাম্পে হাঁটতে দেখা যাবে এক রূপান্তরকামী মডেলকে। তার নাম অঞ্জলি লামা। নেপালের মেয়ে। তিনিই নেপালের প্রথম রূপান্তরকামী মডেল।
নেপালের প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম নেওয়া অঞ্জলি আগামী ‘ল্যাকমে ফ্যাশন উইক’-এ অংশ নেওয়ার জন্য নেপাল থেকে মুম্বাই পাড়ি দেবেন খুব শিগগিরই।
ভারতীয় একটি সংবাদমাধ্যমকে অঞ্জলি বলেন, ''নেপালের নুওয়াকোট অঞ্চলে জন্ম আমার। ছোট থেকেই নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সংকটে ভুগতাম। সমাজের মাপকাঠির সঙ্গে কিছুতেই নিজেকে মেলাতে পারতাম না। ছেলে হয়ে জন্মেছিলাম। মায়ের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। স্কুলেও বেশিরভাগ মেয়েদের সঙ্গেই বন্ধুত্ব হতো। তাই আমার আচার-আচরণ নিয়ে প্রায়ই কথা উঠত। সে সব শুনে নিজেও খুব বিভ্রান্ত হয়ে পড়তাম! গ্রাম থেকে যখন শহরে চলে এলাম, ভেবেছিলাম জীবনটা অন্য রকম হবে। কিন্তু শহুরে ধ্যান-ধারণা আরও কড়া। কিছুই বদলায়নি। কলেজে পড়ার সময় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, নিজের মতো করে বাঁচব। নিজের অস্তিত্ব নিজেই ঠিক করব।''
''২০০৯ সালে প্রথম মডেলিংয়ের সুযোগ পাই। একটা স্থানীয় পত্রিকার প্রচ্ছদের জন্য ফোটোশ্যুট করেছিলাম। অ্যাসাইনমেন্টটা পাওয়ার পর খুবই খুশি ছিলাম। ভেবেছিলাম, আমার পছন্দের কেরিয়ার শুরু হল। কিন্তু তার পরের সফরটা খুবই কঠিন ছিল। প্রায় সব এজেন্সিই আমাকে নাকচ করে দেয়। কারণ একটাই, আমি রূপান্তরকামী! ভেঙে পড়েছিলাম, কিন্তু হাল ছাড়িনি। একটা সময় আমার টানা ব্যর্থতা দেখে বন্ধু-বান্ধবেরা বলেছিল অন্য কেরিয়ার খুঁজে নিতে। আরও জেদ চেপে যায়। ঠিক করে নিই, স্টেরিওটাইপগুলো ভাঙবই। বাবা-মা কেউই আমার লিঙ্গ পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের পাশে দাঁড়ায়নি। সেক্স চেঞ্জ অপারেশনের সব রকম যন্ত্রণা এক মাস ধরে আমি একাই সামলেছি। অর্থনৈতিক চাপ তো ছিলই। কিন্তু নিজের মতো করে বাঁচতে পারব, সেই তাগিদেই জোর পেয়েছি। শুধু পরিবার নয়, গোটা দুনিয়ার সামনেই নিজের সত্যিটা মেলে ধরতে পেরেছি।''
অঞ্জলি বলেন, ''পৃথিবীর কোনও জায়গাতেই রূপান্তরকামীদের সঙ্গে খুব একটা সুবিচার হয় না। সেটা কেরিয়ার হোক কিংবা থাকা-খাওয়া, যা-ই বলুন না কেন। তবে সময় বদলাচ্ছে। মানসিকতাও ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে আমাদেরও সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। ভারতীয় র্যাম্পে হাঁটার সুযোগ পেয়ে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। এখন পর্যন্ত আমার জীবনের সর্বোচ্চ সম্মান, কোনও ভারতীয় ফ্যাশন উইকে অংশ নিতে পারা।''
ল্যাকমে ফ্যাশন উইক’এর ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল থেকেই অডিশনের কথা জানতে পারেন অঞ্জলি লামা। পরে ফর্ম ফিল-আপ করে অ্যাপ্লাই করেন। দু’বার বাদ পড়ার পর অবশেষে সুযোগ মেলে। ভারতের ফ্যাশন জগতে আরও কাজ করার ইচ্ছা অঞ্জলির।
অঞ্জলি বলেন, এখনকার সময়ে পরিবর্তনের সংজ্ঞা নির্ধারণে ফ্যাশন একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। একমাত্র ফ্যাশনই খুব রক্ষণশীল মনোভাব বা পরিস্থিতিকেও ধীরে ধীরে বদলাতে পারে। তবে তৃতীয় লিঙ্গ নিয়ে আরও বেশি সচেতনতা প্রয়োজন। সেটা স্কুলের শিক্ষা থেকে শুরু হওয়া দরকার। কিছু সংস্থার অ্যাপ্লিকেশন ফর্মেই কেবল তৃতীয় লিঙ্গের উল্লেখ থাকে। নইলে আমরা এখনও ‘ছেলে-মেয়ে’র দুনিয়াতেই বাঁচছি। সরকারের পক্ষ থেকে রূপান্তরকামীদের অধিকার নিয়ে আরও পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সূত্র: এবেলা
বিডি-প্রতিদিন/এস আহমেদ