উন্নয়নের নামে বৃক্ষশূন্য হচ্ছে দেশ। প্রতি বছরই দেশে কাটা পড়ছে লাখ লাখ বহু বর্ষজীবী প্রাচীন গাছ। কখনো কৃষির জন্য, কখনো উন্নয়ন প্রকল্প, কখনো ঘরবাড়ি তৈরির জন্য কাটা হচ্ছে এসব গাছ। আবার নানা কুসংস্কার ও প্রতিহিংসার শিকার হয়েও কাটা পড়ছে অনেক গাছ। গত মে মাসে মাদারীপুরে শিরক তকমা দিয়ে প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো একটি বটগাছ কেটে ফেলেন স্থানীয় কিছু মানুষ। শুধু চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণের জন্যই বলি হয় ৭ লাখ ২০ হাজার গাছ। গত এক বছরেই দেশে কেটে ফেলা হয়েছে ১ লাখ ৮১ হাজার ৮১৮টি বড় গাছ। এতে কমছে বনভূমির পরিমাণ। বাড়ছে তাপমাত্রা। বাড়ছে বায়ুদূষণ। ক্রমেই নাজুক হচ্ছে পরিবেশ।
সম্প্রতি রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্স সেন্টার (আরডিআরসি) প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত এক বছরে (২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত) দেশে কেটে ফেলা হয়েছে ১ লাখ ৮১ হাজার ৮১৮টি বড় গাছ। গড়ে প্রতিদিন কাটা পড়েছে ৪৯৯টি গাছ। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গবেষণাটি করা হয়েছে। গবেষকদের ধারণা, গাছ কাটার প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। কারণ, গাছ কাটার অধিকাংশ ঘটনাই গণমাধ্যমে আসে না। মূলত সরকারি জমির গাছ বা উন্নয়ন প্রকল্পের নামে সরকার কোনো গাছ কাটলেই সেটা আলোচনায় আসে। সংবাদপত্রে প্রকাশ হয়।
প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, গত এক বছরে সবচেয়ে বেশি গাছ কাটা হয়েছে খুলনা জেলায়, যার সংখ্যা ৮৫ হাজার। আগের বছর জেলাটিতে মাত্র ২৫টি গাছ কাটার খবর গণমাধ্যমে আসে। এক বছরের ব্যবধানে খুলনায় বৃক্ষনিধন বেড়েছে ৩ হাজার ৪০০ গুণ। এ সময়ে ঢাকায় কাটা পড়েছে ৪ হাজার ২৯৬টি গাছ। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৫৮১টি। ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় দুই হাজার, পান্থকুঞ্জ পার্কে দুই হাজার, ধানমন্ডি লেক এলাকায় ৩০টি, শাহবাগে ছয়টি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৬০টি গাছ কাটা হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে ঢাকায় বৃক্ষনিধন বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৭ গুণ। তথ্য বলছে, কারওয়ান বাজারের পান্থকুঞ্জ পার্কের বুকচিরে এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প করতে গিয়ে কেটে ফেলা হয় প্রায় ৪০ প্রজাতির দুই হাজার গাছ। পরিবেশবাদীরা মাসব্যাপী আন্দোলন, অবস্থান ও বিবৃতি দিয়েও রক্ষা করতে পারেননি গাছগুলোকে। ফলে এক বছর আগেও সন্ধ্যা হলে যে পার্কটি মুখরিত হতো পাখির কলকাকলিতে, সেখানে এখন শুধুই গাড়ির হর্ন ও বিভিন্ন যান্ত্রিক শব্দ।
তথ্য বলছে, যে কোনো দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা আবশ্যক। আর বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে বন আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ ১৭.৩১ শতাংশ।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য বলছে, বাংলাদেশে বন আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ ১৫.৭৮ শতাংশ। অর্থাৎ প্রয়োজনের তুলনায় ৮-১০ ভাগ বনভূমি কম রয়েছে। সেখানে প্রতি বছরই উন্নয়নের বলি হচ্ছে লাখ লাখ গাছ। আরডিআরসির গবেষণার তথ্য বলছে, ২০০১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ২ লাখ ৬২ হাজার হেক্টর বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা হারিয়েছে, যার পরিবেশগত ক্ষতি ১৫ কোটি ২০ লাখ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের সমান।
তবে গত এক বছরে চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, সাতক্ষীরা, শেরপুরসহ অনেক জেলায় গাছ কাটা কমেছে। এতে আগের বছরের তুলনায় মোট বৃক্ষনিধনের পরিমাণ প্রায় ৮৪ শতাংশ কমেছে বলে গবেষণায় দাবি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশে গত এক বছরে ১ লাখ ৮১ হাজার ৮১৮টি গাছ কাটা হয়েছে, যা আগের বছরে ছিল ১১ লাখ ৪৬ হাজার ৪৬৫টি। চট্টগ্রামে গত এক বছরে কাটা হয়েছে ৬ হাজার ২৬০টি গাছ। আগের বছর (২০২৩-২৪) কাটা হয় ৫ লাখ ৬ হাজার ২২২টি। এ ছাড়া মানিকগঞ্জ, চাঁদপুর, বরিশাল, গোপালগঞ্জ, ঝালকাঠি, নড়াইলসহ কিছু জেলায় কোনো বড় গাছ কাটার খবর পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে গত এক বছরে বেশি গাছ কাটার দিক দিয়ে খুলনার পরেই লক্ষ্মীপুরে ১৫ হাজার ২৪২টি, কুষ্টিয়ায় ১১ হাজার ১৭৬টি, ঝিনাইদহে ১০ হাজার ৯৫৬টি, যশোরে ৯ হাজার ৪০৩টি, পঞ্চগড়ে ৭ হাজার ৫০০টি, ঠাকুরগাঁওয়ে ৫ হাজার ১৫৩টি গাছ কাটা হয়েছে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, উন্নয়নের নামে বড় বড় প্রাচীন গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। অন্যদিকে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির নামে অর্থ খরচ করে গাছের চারা লাগানো হচ্ছে। বিপুল অর্থ খরচ করে বিদেশ থেকে আগ্রাসী গাছের চারা এনে লাগানো হচ্ছে।
মূলত এটা একটা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। অথচ একটা গাছের চারা বড় হয়ে তার পূর্ণমাত্রায় কার্বন ধারণসক্ষমতা অর্জন করতে অন্তত ১০ বছর লাগে। ধীরে ধীরে সেটা বাড়ে। ১০ বছর বয়সি একটা বড় গাছ যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে, সেটা করতে কয়েক শ গাছের চারা প্রয়োজন। তাই বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বড় গাছ বাঁচানো।