উর্দু ও হিন্দিতে একটি প্রবাদ আছে: “দের আয়ে দুরস্ত আয়ে” -- দেরিতে এসেছে ঠিকভাবে এসেছে।” ইংরেজিতে সমার্থক কথা চালু আছে: “বেটার লেট দ্যান নেভার” -- একেবারে না হওয়ার চেয়ে বরং বিলম্বে হোক। একটু বিলম্ব হলেও আমার অনুবাদ করা আরেকটি বই আসছে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বই: “বাংলাদেশ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ ও শান্তি।” লেখক খুশবন্ত সিং। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিউইয়র্ক টাইমস এর জন্য যেসব রিপোর্ট করেছেন সেই রিপোর্টগুলোর সংকলন। তিনি সীমান্ত এলাকায় ঘুরেছেন, শরণার্থী শিবিরে গেছেন, গোপন অবস্থানে বাংলাদেশ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানি, ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লে: জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের সেনাপ্রধান লে: জেনারেল টিক্কা খানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এছাড়াও সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, কমরেড মনি সিং, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদসহ আরও অনেকের। বাংলাদেশের জন্ম ও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের অনেক কথা ওঠে এসেছে তার বইয়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস জানার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বই।
খুশবন্ত সিং রচনার সঙ্গে ইতোমধ্যে যারা পরিচিত তারা তাদের মনে প্রায় গেঁথেই নিয়েছেন যে খুশবন্তু সিং এর লেখা মানেই যৌন সুড়সুড়ি বা অনেক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের যৌন মিলনের রগরগে বর্ণনায় ঠাসা কাহিনি। কিন্তু তাঁর সিরিয়াস নন-ফিকশন গ্রন্থের সংখ্যাও কম নয় এবং “বাংলাদেশ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ ও শান্তি” তার সিরিয়াস বইয়ের একটি। বই আকারে লেখাগুলো আমার হাতে এসেছে বইটি প্রকাশিত হওয়ার ৪৪ বছর পর। ১৯৭৬ সালে ১৫২ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশ করেছিল দিল্লির “হিন্দ পকেট বুক” এবং মূল্য ছিল ছয় রুপি। পরবর্তীতে এর আর কোনো সংস্করণ প্রকাশিত না হওয়ায় এটি কখনো আমার দৃষ্টিতে পড়েনি। প্রায় পনের বছর যাবত খুঁজছিলাম বইটি। ১৯৯২ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত আমার সাংবাৎসরিক দিল্লি সফরের তালিকায় ঐতিহাসিক স্থানগুলো পরিদর্শনের বাইরে একটি মাত্র কাজই থাকত, বই কেনা। দিল্লিতে বই কেনার সেরা জায়গাগুলোর মধ্যে খান মার্কেট, কনট প্লেস, দরিয়াগঞ্জ অন্যতম। চষে বেড়াতাম জায়গাগুলো। কিন্ত দরিয়াগঞ্জের পুরনো বইয়ের দোকানগুলোতেও আমার কাঙ্ক্ষিত বইটির সন্ধান পাইনি। কেউ নামই শোনেনি। ইন্টারনেটের কল্যাণে গতবছর বইটির সন্ধান পাই। আমাজন মূল্য দেখায় ১২৪ ডলার ৯৯ সেন্ট। এর সাথে আরও ৪/৫ ডলার যোগ হবে শিপিং চার্জ। সাধ্যের বাইরে। কিন্তু মাথা থেকে বইটির চিন্তা নামিয়ে ফেলতে পারি না। অবসর পেলেই নেটে বইটি খুঁজি।
অবশেষে “লাইট অ্যাট দ্য এন্ড অফ দ্য টানেল।” কুইন্স পাবলিক লাইব্রেরি সিস্টেমসে বইটির অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম। নিউইয়র্ক সিটির পাঁচটি বরোর মধ্যে কুইন্স বরো জনসংখ্যা ও বৈচিত্র্যে বেশি সমৃদ্ধ। কুইন্স পাবলিক লাইব্রেরিও একইভাবে সমৃদ্ধ। এটির শাখা আছে ৯০টি এবং বইয়ের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। কুইন্স লাইব্রেরির বেশ ক’জন বাংলাদেশি কর্মকর্তা আমার পরিচিত। তাদের মধ্যে আবদুল্লাহ জাহিদ অন্যতম। তিনি ময়মনসিংহের লোক। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন ফিশারিজ এ। যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর লাইব্রেরি সায়েন্সে ডিগ্রি নিয়ে কুইন্স লাইব্রেরির হলিস শাখার ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাকে বলার পর তিনি বললেন, বই থাকলে অবশ্যই পাওয়া যাবে। ক’দিন পর তিনি জানালেন, কুইন্স পাবলিক লাইব্রেরি সিস্টেমসে বইটি নেই। তবে সাইরাকিউজ ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে আছে। ওখান থেকে নিয়ে আসা কোনো সমস্যা নয়। বইয়ের ইন্টার-লাইব্রেরি লোন ব্যবস্থার আওতায় যে কেউ সহজে প্রয়োজনীয় বই ধার নিতে পারেন। আমার খরচ হবে ২৫ ডলারের মতো। তাকে বলি ‘কুচ পরোয়া নেই,’ আপনি নিয়ে আসুন। ক’দিন পর বইটি আসে। তিনি জানান, ২৫ ডলার নয়, ১২ ডলার দিলেই চলবে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বইটি ইস্যু করা হয়েছে। আমি মে মাস পর্যন্ত রাখতে পারব। লাইব্রেরিতেই স্ক্যানার আছে। আমি ইচ্ছে করলে বিনা খরচে স্ক্যান প্রিন্ট নিতে পারি অথবা চার মাস বইটি আমার কাছে রেখে আমার প্রয়োজন সেরে নিতে পারি। বইটি নিয়ে আসি। সব অনুবাদ স্থগিত রেখে এটি অনুবাদে হাত দেই।
অনুবাদ করার পর্যায়েই নতুন প্রকাশনা সংস্থা ‘স্বরে অ’র রাজু আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। আবু বকর সিদ্দিক রাজু। শুধু তার ‘স্বরে অ’ নতুন প্রতিষ্ঠান নয়, বয়সে সে নিজেও তরুণ। বছর খানেক আগে সে আমাকে খুঁজে বের করেছে। কোনো বইয়ের ফ্ল্যাপে আমার জন্মস্থান ‘শেরপুর’ দেখে ফেসবুকে নক করেছিল। ওর বাড়িও শেরপুর। সদ্য প্রকাশনা ব্যবসায়ে এসেছে। বেশ কথা চালাচালি হয়। প্রকাশনায় ওর আগ্রহ আমাকে অবাক করে। আমাদের এলাকার লোকজন ধানচাল, পাট চাষ ও এসবের ব্যবসা এবং এর বাইরে কিছু ভাবলে বড় জোর একটি চাকুরির কথা ভাবে। রাজনীতিতেও তেমন বড় কোনো নেতার আগমণ ঘটেনি। সেই কোন আমলে জিয়াউর রহমানের সময় খন্দকার আবদুল হামিদ বিএনপি সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন। হাল আমলে মতিয়া চৌধুরী মন্ত্রী হয়েছেন। আসলে তিনি জন্মসূত্রে আমাদের এলাকার নন। শেরপুর তাঁর শ্বশুর বাড়ি। বইপত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি করার লোকজনও কম। আমি যখন স্কুলের ছাত্র তখন লাইব্রেরি বলতে বুঝতাম বইয়ের দোকান, যেখানে স্কুল কলেজের বই, খাতা-কলম-পেন্সিল ইত্যাদি বিক্রয় হয়। এমন দুটি লাইব্রেরির মধ্যে একটির মালিক ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। পরবর্তীতে তিনি শেরপুর জেলা বিএনপির সভাপতি হয়েছিলেন। আবদুর রাজ্জাক সাহেব সম্ভবত ১৯৬৭ সালে ‘চলার পথে’ নামে তার লেখা একটি উপন্যাস প্রকাশ করেন নিজের উদ্যোগেই। সে কি অবস্থা। রীতিমতো শেরপুরের সেলিব্রিটিতে পরিণত হন তিনি। সে উপন্যাসটির মানগত দিক বিচারের বয়স তখন হয়নি। সেটিই শুরু এবং আমার ছাত্র থাকাকালে সম্ভবত শেষ। শেরপুরের আর কারও কোনো বই প্রকাশ হতে দেখিনি। কিন্তু লেখা এক ব্যাপার প্রকাশনার ব্যবসা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেজন্য রাজু’র প্রকাশনা ব্যবসায়ের প্রতি আগ্রহ আমাকে বিস্মিত করেছিল।
যাহোক, খুশবন্ত সিং এর বইটি অনুবাদের পর্যায়েই রাজুকে বলি যে বইটি ওকে প্রকাশ করতে দেব। আমি এর আগেও বলেছি, মৃত্যু নিয়ে আমি প্রচুর হাসিঠাট্টা করি। মৃত্যুকে ভয়ও করি না। কিন্তু যখনই কোনো বইয়ের অনুবাদ শুরু করি, সেটি শেষ না করা পর্যন্ত আমার মাঝে মৃত্যু চিন্তা প্রবলভাবে কাজ করে। আস্ত একটা বইয়ের দশ/বিশ পৃষ্ঠা অনুবাদ করা বাকি থাকতেই যদি মৃত্যুর ফেরেশতা এসে ডাক দেয়, ‘চলো মিয়া, বহুত হয়েছে’। কী হবে আমার অসমাপ্ত কাজগুলোর? আমি তো আর আল্লাহর দোস্ত মূসা নবী নই যে, মৃত্যুবরণ করার ইচ্ছা নেই বলে আজরাইলকে থাপ্পড় মেরে একটা চোখ খসিয়ে দেব ! আর আজরাইল আল্লাহর কাছে ফিরে গিয়ে বলবে, “হে প্রভু, আপনি যার কাছে পাঠিয়েছিলেন, সে তো মরতে চায় না।” অতএব আমাকে মরতে হবে এবং সেই চিন্তা মাথায় রেখেই আমাকে কাজ করতে হয়। বইটির অনুবাদ যথাসময়ে শেষ করি এবং রাজুর কাছে পাঠিয়েও দেই, সম্ভবত গত বছরের সেপ্টেম্বরে। করোনা পরিস্থিতিসহ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি প্রকাশনা ব্যবসার জন্য অনুকূল ছিল না। বিক্রি না হলে বই কার জন্য প্রকাশ করবে। বই তো খাদ্যসামগ্রী নয় যে বাঁচার তাগিদে কিনতে হবে। রাজু নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। করোনাভাইরাসজনিত কারণে না হলেও বেশ অসুস্থ ছিল। একুশের বইমেলা হবে কিনা তা নিয়েও সংশয় ছিল। এভাবে বইটির প্রকাশনা বিলম্বিত হচ্ছিল। বইমেলা যখন শুরু তখন জীবিত থাকতেই বইটির প্রকাশ হওয়ার কথা শুনে যাওয়ার আগ্রহ প্রবল হলে রাজু আশ্বাস দিলো, চিন্তার কারণ নেই, বইটি দ্রুত প্রকাশিত হবে।
বইয়ের নাম: বাংলাদেশ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ ও শান্তি
লেখক: খুশবন্ত সিং
অনুবাদক: আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান: ‘স্বরে অ’
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা