ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে এখন পরাশক্তিগুলোর জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে। ইরানে আকস্মিক মার্কিন হামলার পর এই আশঙ্কা আরো তীব্র হয়েছে। যেকোনো সময় এটি আঞ্চলিক সংঘাতে পরিণত হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। চরম উত্তেজনার মধ্যে ইরানের পার্লামেন্ট হরমুজ প্রণালি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেকোনো সময় তা কার্যকরের নির্দেশ এলে বিশ্ব অর্থনীতিতে আরেকটি ধাক্কা অবধারিত। এতে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। আর তা বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দিতে পারে।
যুদ্ধ শুরুর পর এরই মধ্যে ১০ শতাংশের বেশি বেড়ে গেছে জ্বালানি তেলের দাম। এতে খাদ্যপণ্যসহ সব কিছুরই দাম বাড়তে পারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও এমন ঘটেছিল।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশের প্রবাস আয় ও আমদানি-রপ্তানিতে বড় ধাক্কা আসতে পারে। তাঁরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমবাজারে জটিলতা তৈরি হলে অনেক প্রবাসী চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়বেন। আমদানি-রপ্তানি চেইন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তেল-গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থায় আঘাত এলে দেশের শিল্প খাত আবার নতুন করে সংকটে পড়তে পারে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ইরানের ফরদো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে সংঘাত উসকে দিয়েছে এবং ইসরায়েল-ইরানের চলমান যুদ্ধকে আরো জটিল ও বিস্তৃত করে তুলেছে। এর ফলে পুরো অঞ্চল এক অনিশ্চিত ও বিপজ্জনক ভবিষ্যতের দিকে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা, সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্ন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের জন্য এই ঘটনার অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব হতে পারে গভীর। বিশেষত জ্বালানির দাম বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি তীব্র হতে পারে, আর মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত লাখো বাংলাদেশি শ্রমিকের নিরাপত্তা ও রেমিট্যান্সপ্রবাহ অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে। রপ্তানি খাত ও সামুদ্রিক বাণিজ্য পরিবহন ব্যবস্থায়ও চাপ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে এবং একই সঙ্গে অর্থনীতিতে সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে হবে।’
উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক এম কে মুজেরী বলেন, ‘এই যুদ্ধ শুধু দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এরই মধ্যে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা তৈরি করেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকটাই মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার সঙ্গে জড়িত। এই যুদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশে জ্বালানি আমদানি, শ্রমবাজার ও সরবরাহে প্রভাব পড়তে পারে। এর ফলে বাংলাদেশে বিনিয়োগে প্রভাব পড়বে। বাড়বে পরিবহন ভাড়া, পণ্যের উৎপাদন খরচ। মূল্যস্ফীতিতেও প্রভাব ফেলবে।’
হরমুজ প্রণালি বন্ধের আশঙ্কা
হরমুজ প্রণালি বিশ্বজুড়ে তেলের ‘করিডর’ হিসেবে পরিচিত। সারা পৃথিবীর মোট জ্বালানি তেলের ২০ শতাংশ এই জলপথের মাধ্যমে পশ্চিম এশিয়া থেকে বহির্বিশ্বে রপ্তানি করা হয়।
জ্বালানি বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান যদি হরমুজ প্রণালি দিয়ে জাহাজ চলাচল দীর্ঘদিনের জন্য বন্ধ করে দেয়, তাহলে বাংলাদেশের জ্বালানি তেল আমদানি খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই জলপথ দিয়েই বিশ্বের প্রায় এক-চতুর্থাংশ তেল এবং ২০ শতাংশ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস পরিবহন করা হয়। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে তেল আমদানির ক্ষেত্রে বাড়তি ব্যয় ও অস্থিরতার মুখোমুখি হতে হতে পারে।
জ্বালানি আমদানি
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের প্রভাবে জ্বালানি তেলের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে সব ধরনের জ্বালানি পণ্যের দাম বেড়েছে। বিশ্বের জ্বালানি তেল সরবরাহের খুবই গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সমুদ্র রুট হরমুজ প্রণালি বন্ধের অনুমোদন দিয়েছে ইরানের পার্লামেন্ট। ফলে হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে জ্বালানি তেলের দামে বড় উত্থান ঘটতে পারে। ব্যাহত হতে পারে জ্বালানি তেল আমদানি। এমন পরিস্থিতিতে বিকল্প উৎস খুঁজছে সরকার।
বাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং ইকোনমিকস জানায়, গত এক সপ্তাহে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ১০ শতাংশ বেড়েছে। এক মাসে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে ২২ শতাংশের বেশি।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যে চলমান অস্থিরতা দীর্ঘায়িত হলে দাম নির্ধারণের ওপর প্রভাব পড়বে। পাশাপাশি হরমুজ প্রণালির মাধ্যমে তেল পরিবহনে ঝুঁকি বৃদ্ধির কারণে জাহাজভাড়া বাড়বে। জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে সাত লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির কথা রয়েছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান (সচিব) মো. আমিন উল আহসান বলেন, ‘আমরা মূলত পরিশোধিত ও অপরিশোধিত এই দুই ধরনের জ্বালানি তেল আমদানি করে থাকি। সৌদি আরব ও দুবাই থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল (ক্রুড অয়েল) আমদানি করা হয়। শুধু এই তেলই ইরানের হরমুজ প্রণালি হয়ে আসে। তাই এই তেল সরবরাহে কিছুটা ঝুঁকি রয়েছে। যদি কোনো কারণে সৌদি আরব ও দুবাই থেকে অপরিশোধিত তেল আনতে না পারি, তাহলে বিকল্প দেশ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে তেল আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে।’
রপ্তানি খাত
চলমান সংঘাত ও যুদ্ধাবস্থা শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, সারা বিশ্বের অর্থনীতি ও সরবরাহব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) নবনির্বাচিত সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু। তিনি বলেন, ‘ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে। তেলের দাম বাড়লে উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বাড়বে, যার প্রভাব সরাসরি পড়বে আমাদের পোশাকশিল্পে। ক্রেতারাও তাদের ক্রয়াদেশ নিয়ে আরো সতর্ক হয়ে পড়তে পারেন। এতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পেও চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে।’
রেমিট্যান্স
দেশের অর্থনীতির একটি অন্যতম চালিকাশক্তি হলো প্রবাস আয় বা রেমিট্যান্স। প্রতিবছর ২০ থেকে ২২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স আসে, যার বড় অংশই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে আসে। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ যদি বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে মধ্যপ্রচ্যে কর্মসংস্থান হ্রাস, শ্রমিক ফেরত আসা কিংবা রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়বে, যা টাকার মান এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রভাব ফেলবে।
বৈদেশিক বাণিজ্যে চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো আমদানিনির্ভর। খাদ্যশস্য, জ্বালানি, শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল, সার, ভোগ্যপণ্য বেশির ভাগই আমদানি করতে হয়। যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ চেইন ব্যাহত হলে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। একই সঙ্গে জাহাজ চলাচলে বিলম্ব ও খরচ বাড়তে পারে।
বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এই পরিস্থিতিতে আমদানির খরচ বাড়বে, কাঁচামালের সরবরাহে সংকট দেখা দিতে পারে এবং দেশের ভোক্তা বাজারে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে।
সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ