গত ৩ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ নিরসনের দায়িত্ব তাদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে। ফ্যাসিবাদবিরোধী দলগুলো নিজেরা আলাপ আলোচনা করে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নেবে। আগামী সাত দিনের মধ্যে এ ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। সাত দিনের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো যদি একমত হতে না পারে তাহলে সরকার এককভাবে এ ব্যপারে সিদ্ধান্ত নেবে বলেও ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু উপদেষ্টা পরিষদের এই সিদ্ধান্তের দিনই বিএনপি ২৩৭টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে রাজনৈতিক অঙ্গনে নির্বাচনি আবহ সৃষ্টি করে। গোটা দেশ নির্বাচনমুখী করতে বিএনপির এই কৌশল যথেষ্ট কার্যকর হয়েছে। এই এক সিদ্ধান্ত দেশে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার কালোমেঘ অনেকটাই দূর করে দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো এখন তাদের নিজস্ব এজেন্ডা নিয়ে মাঠ গরম করা ছেড়ে মনোনয়ন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এনসিপি ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছে যে তারা চলতি মাসের মধ্যেই তাদের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করবে। বুধবার জামায়াতের আমির ঘোষণা করেছেন, তারা কোনো নির্বাচনি জোট করবে না। অর্থাৎ বিএনপির একটি সিদ্ধান্ত সবদলকে নির্বাচনের মাঠে নামিয়ে দিয়েছে। সাধারণ মানুষ আশাবাদী হতে শুরু করেছে। সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, শেষ পর্যন্ত যাই হোক, নির্বাচন হবেই। কিন্তু আমরা ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পাই। দেশে যেমন একটি নির্বাচনি আবহ তৈরি হয়েছে তেমনি, নির্বাচনবিরোধী শক্তি এখনো সক্রিয়। নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র এখনো চলছে। তাই জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, গণভোট কখন হবে এবং গণভোটে কী প্রশ্ন শেষ পর্যন্ত থাকবে- এ বিষয়গুলো যে কোনো সময় রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত করে তুলতে পারে। তাই, এ বিরোধ যত তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি হবে তত দেশে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হবে।
রাজনৈতিক দলগুলো এখন পর্যন্ত প্রধান উপদেষ্টার আহ্বানে সাড়া দিয়ে আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো কেউই আলোচনার বিপক্ষে নয়। কিন্তু এ আলোচনার উদ্যোগ নেবে কে? বিড়ালের গলায় ঘণ্টা পরাবে কে?
রাষ্ট্রনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, শেষ পর্যন্ত এভাবে সমাধান হবে না। তারা মনে করেন, গত আট মাসে রাজনৈতিক দলগুলো এ নিয়ে বহুবার আলোচনা করেছে। আট মাসে যেহেতু তারা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি, তাই সাত দিনের মধ্যে তারা একমত হবেন, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। অনেকেই মনে করেন, সরকার যেন বুঝেই এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুরুতেই যদি সরকার এককভাবে সিদ্ধান্ত নিত তাহলে এ নিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। কারণ, সরকারের সিদ্ধান্ত কারও পছন্দ হতো কারও হতো না। সরকারের সিদ্ধান্তে অখুশি পক্ষ, নির্বাচনের আগে একটি আন্দোলন শুরু করলে, সেটা যেমন নির্বাচনের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতো তেমনি সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠত। এ কারণেই সরকার বল রাজনৈতিক দলের কোর্টে ঠেলে দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যখন একমত হতে পারবে না, তখন সরকার একক সিদ্ধান্ত নিলে, কারও কিছু বলার থাকবে না। সরকারের সিদ্ধান্তে আপত্তি থাকলেও তারা কিছু করতে পারবে না- কারণ তাদের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। সেই সুযোগ রাজনৈতিক দলগুলো কাজে লাগাতে পারেনি।
প্রশ্ন হলো, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের ব্যাপারে সরকার কী সিদ্ধান্ত নেবে? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের ৩ নভেম্বরের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের বিষয়ে জানতে হবে। ওই বৈঠকে বেশির ভাগ উপদেষ্টাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন, একই সঙ্গে গণভোটের প্রস্তাব করেন। আমার মতে, বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য এটাই সবচেয়ে ভালো বিকল্প। এতে কোনো পক্ষেরই আপত্তি থাকার কথা নয়। যদিও জামায়াতের দাবি হলো, চলতি মাসেই গণভোট করা। কিন্তু জামায়াতের এটি কৌশলগত অবস্থান। দলটির নেতারা খুব ভালো করেই জানেন, নির্বাচন কমিশন, এই স্বল্প সময়ের মধ্যে গণভোটের আয়োজন করতে পারবে না। এবার থাকে গণভোটের প্রশ্ন বিতর্ক। উচ্চ কক্ষের নির্বাচন পিআর পদ্ধতি, একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী এবং দলের সভাপতি থাকতে পারবে না-সহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে বিএনপিসহ কয়েকটি দলের আপত্তি আছে। জুলাই সনদে সংবিধান সংশোধনের ৪৮চি প্রস্তাবের কয়েকটি নিয়ে বিতর্ক আছে, আছে বিভক্তি। সরকারের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ হবে, যদি তারা, বিতর্কিত সুপারিশগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার নির্বাচিত সরকারের হাতে ছেড়ে দেয়। তফসিল-১ সংশোধন করে, শুধু যেসব সংবিধান সংশোধনী বিষয়ে সকলে একমত সেসব নিয়ে গণভোট করে। অন্তর্র্বর্তী সরকার হিসেবে তারা নির্বাচিত সরকারের প্রতি এ আহ্বান জানাতে পারে যে, জাতীয় সংসদে জুলাই সনদের প্রতিটি প্রস্তাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যেতে পারে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সিদ্ধান্তের আলোকে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি করা হবে। এরকম একটি দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত নির্বাচনের শেষ বাধা দূর করতে পারে। দেশে একটি উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচনই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ। তাই আমরা সাধারণ জনগণ প্রত্যাশা করি, ড. ইউনূসের সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে এবং জনগণকে স্বস্তি দেবে।