একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন ইসহাক মুন্সি। একদিন তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ভেসে ওঠে জুয়ার সাইটের (বাবু ৮৮৮) বিজ্ঞাপন। কৌতূহলবসত জুয়ার সাইটে তিনি ঢুকে পড়েন। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১ হাজার টাকা জমা করে ক্যাসিনো খেলা শুরু করেন। মুহূর্তের মধ্যে তার এই ১ হাজার টাকা ২৫ হাজার টাকা হয়ে যায়। সেই থেকে শুরু। কয়েকদিনের মধ্যে জুয়া খেলা তার নেশায় পরিণত হয়ে যায়। হারতে থাকেন। আবার জিততেও থাকেন। মাত্র এক মাসের মধ্যেই ভিটেমাটি বন্ধক রেখে ১৮ লাখ টাকা জুয়ার পেছনে খোয়ান। কিন্তু থেমে যাননি তিনি। আত্মীয়-স্বজনসহ বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে আরও ৯ লাখ টাকা ধার করেন। চাকরির বেতনে চলা ইসহাক মুন্সির জীবন এখন ঋণের বোঝায় জর্জরিত। পাওনাদারদের ভয়ে ছেড়েছেন চাকরি। বাসাতেও থাকতে পারেন না। এখন তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
ছোট পানের দোকান দিয়ে কোনোরকমে সংসার চালাতেন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের রতন চন্দ্র দেবনাথ। অনলাইনে জুয়ার পাল্লায় পড়ে ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন রতন। শুধু ইসহাক ও রতনই নন, অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। ঘর ভাঙছে। অশান্তিতে পড়ছে পরিবার। সম্পর্কের ছেদ ঘটছে অহরহ। এরপরও মানুষ থামছে না। বিভিন্ন জুয়া সাইটের নাম এখন মানুষের মুখে মুখে।
জানা গেছে, বিনা পরিশ্রমে লাখোপতি হওয়ার স্বপ্নে উঠতি বয়সি তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে রিকশাচালক, দোকানি, দিনমজুর, কৃষক, চাকরিজীবী এমন কেউ নেই অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হচ্ছেন না। ধনাঢ্য শ্রেণির মানুষও অনলাইন জুয়ায় ঝুঁকছেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে, খেলার মাঠ, চায়ের দোকান, রাস্তার মোড়, গাছের ছায়া, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ভ্যানগাড়িতে বসে অবাধে চলছে অনলাইন জুয়া।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সীমাবদ্ধতা, লোভে পড়ে উপার্জনের ক্ষেত্র মনে করা ও অপরাধীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার কারণে জুয়া এখন নীরব মহামারিতে পরিণত হয়েছে। ডিবি, সিটিটিসি ও সিআইডির সাইবার ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, হাজারো অনলাইন জুয়ার সাইটে লাখ লাখ মানুষ আসক্ত হয়ে পড়েছে। বিদেশ থেকে পরিচালিত এসব অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে হুন্ডি ও ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা পাঁচার হয়ে যাচ্ছে। অবৈধভাবে পাচারের এ ফাইন্যান্সিয়াল রুট বন্ধ না হলে শুধু ধরপাকড়ে থামানো যাবে না জুয়ার বিস্তার।
যে কৌশলে চলছে জুয়ার সাইট : ডিবির সাইবার পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, আমাদের দেশে অনলাইন জুয়ার সাইটগুলো মূলত পাঁচটি দেশ থেকে পরিচালিত হচ্ছে। আমেরিকা, মালয়েশিয়া, চীন, দুবাই ও রাশিয়া। ধনাঢ্য শ্রেণি বা যাদের কাছে অলস টাকা আছে, তারাই এ অনলাইন জুয়ার ব্যবসায় বিনিয়োগ করছে। শুরুতে মেলবেট, ওয়ানএক্সবেটসহ জনপ্রিয় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বেটিং সাইটের সঙ্গে চুক্তি করে তারা। চাহিদামতো টাকা পেলে সাব-এজেন্ট হিসেবে থার্ডপার্টি বিনিয়োগকারীকে তাদের সার্ভারে এক্সেস দেওয়া হয়। পরে বিনিয়োগকারী নিজের ইচ্ছামতো তার সাইটের নাম দেন। বেটিং সাইটের লেনদেনের জন্য পে-কিসমা (জুয়াড়িদের দেওয়া লেনদেন চক্রের নাম) চক্রের মাধ্যমে দেশব্যাপী এজেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়। এ চক্রে বেকার তরুণ-তরুণী ও মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টরা থাকে। জুয়ার খেলোয়াড় যখন বিকাশ, রকেট, নগদসহ বিভিন্ন মাধ্যমে টাকা পাঠান, তখন পে-কিসমার নিয়োগ করা এজেন্টরা টাকা পান। এ এজেন্টরা নির্দিষ্ট টাকা কমিশন রেখে ক্রিপ্টোকারেন্সি অথবা হুন্ডির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করছে বিদেশে। বিনিময়ে পে-কিসমা পাচ্ছে নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে টাকা সংগ্রহের এজেন্টরা গ্রেপ্তার হলেও অন্য সব হোতারা দেশের বাইরে থাকায় থেকে যাচ্ছেন অধরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আর বেটিং সাইটের সার্ভার পর্যন্ত যেতে পারেন না।
দুবাইয়ে ঘাঁটি গেড়েছে বাংলাদেশি চক্র : গত বছরের জানুয়ারি সাইবার প্যাট্রলিংয়ে বেশকিছু অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পেয়ে ১২ জনকে শনাক্ত করে কাউন্টার টেরোরিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। তাদের নাম উল্লেখ করে ওই বছরের ২০ জানুয়ারি রমনা থানায় একটি মামলা (নম্বর-১১) করে পুলিশ। আসামিরা হলেন- রবিউল আওয়াল, শাহ রায়হান উদ্দিন আখঞ্জী, হাসানুজ্জামান, রবিউল ইসলাম, আমির মিয়া, সোহেল, আবদুর রশিদ, মাসুম বেপারী, রাশেদ বেপারী, ইমরান রহমান রোহান, মাহাবুর রহমান ও গোলাম ফারুক। এ মামলার তদন্তে নেমে রুবেল মিয়া, জলিল ও মাসুদ রানা নামে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সম্প্রতি এ মামলার চার্জশিট দিয়েছে সংস্থাটি। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েপ্রণ, গ্রেপ্তার আসামিরা জামিনে বের হওয়ার পর দুবাই চলে গেছেন। এমনকি বেশির ভাগ আসামির বর্তমান ঠিকানা এখন দুবাই। সেখানে বসে তাদের বেটিং সাইটগুলো পরিচালনা করে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে পুলিশের আর কিছুই করার থাকছে না। শুধু এই আসামিরাই নন, শতাধিক বাংলাদেশি হোতা দুবাই বসে বেটিং সাইট পরিচালনা করছেন। আর বাংলাদেশি এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে রেডিটিম অ্যাপসে।
ব্যবস্থা নিতে চার চ্যালেঞ্জে পুলিশ : সাইবার পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, অনলাইন জুয়ার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে কেউ মামলা করতে চায় না। যারা জুয়া খেলে তারাও অপরাধী, এ ভয়ে মামলা করাতে কাউকে রাজি করানো যায় না। সাক্ষীও মেলে না। এ ক্ষেত্রে পুলিশ বাদী হয়ে মামলার সুযোগ থাকলেও নানা কারণে অনাগ্রহ কাজ করে। মাঝেমধ্যে হাতেগোনা মামলা হলেও জুয়ার সাইটগুলোর হোতারা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কারণ মূলহোতা ও জুয়ার সাইটের প্রধান সার্ভার দেশের বাইরে হওয়ায় নিরুপায় থাকতে হয় পুলিশকে।
অন্যদিকে বাংলাদেশি যারা এজেন্ট রয়েছেন, তারা ব্যবহার করছেন ভিন্ন রেজিস্ট্রেশনের সিম এবং ভুয়া নামে করা মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর। যারা দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকেন। অনেকের আবার আলিশান লাইফ। ব্যবসার আড়ালে তারা জুয়া কারবারে জড়িয়ে পড়ছেন। এতে করে মোটা অঙ্কের লেনদেনকে ব্যবসায়িক আয় হিসেবে দেখাচ্ছেন। অনেক সেলিব্রেটি বেটিং সাইটগুলোর বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে অংশ নেওয়ায় সাধারণ মানুষ আকৃষ্ট হচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখেই পুলিশ অনলাইন জুয়া নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান সিটিটিসির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ সালাউদ্দিন শিকদার।
জুয়া মানসিক রোগ, প্রয়োজন সচেতনতা : অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল?্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, জুয়াকে উপার্জনের ক্ষেত্র মনে করা ও অপরাধীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় দিন দিন জুয়ায় আসক্তির সংখ্যা বাড়ছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, অনলাইন জুয়া প্রথমত অপরাধ এবং মানুষ যখন এটিতে আসক্ত হয়ে যায় তখন এটি মানসিক রোগে রূপ নেয়। কারণ জুয়া না খেলতে পারলে আর তার ভালো লাগে না, সংসার জীবনে অশান্তি শুরু করে। এ ক্ষেত্রে পরিবারের উচিত জুয়ায় আসক্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
ডিবির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড সাপোর্ট সেন্টারের (দক্ষিণ) যুগ্ম পুলিশ কমিশনার সৈয়দ হারুন অর রশীদ বলেন, শুধু আইন প্রয়োগ করে অনলাই জুয়া নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে মানুষকে সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে- বেটিং সাইটে নাম লেখালে ধ্বংস অনিবার্য। নিঃস্ব হওয়া থেকে তাকে কেউ ঠেকাতে পারবে না। সিআইডি সাইবার পুলিশ সেন্টারের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, জুয়ার সাইট ও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) এজেন্টদের তালিকা করা হচ্ছে। সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ অনুযায়ী দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর বিটিআরসির সহযোগিতায় সাইটগুলো বন্ধ করা হবে।