রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

চলছে তিন মাফিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ

জি কে শামীমের বিরুদ্ধে তিন মামলা, ফিরোজের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদকের মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক

চলছে তিন মাফিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ

ওরা তিনজন। খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, জি কে শামীম এবং শফিকুল আলম ফিরোজ। তিন সাম্রাজ্যের তিন রাজা। তিনজনই শাসক দলের নেতা। ক্যাসিনো নিয়ে তোলপাড় শুরু হওয়ার পর যে নামটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে তিনি হলেন যুবলীগ  নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। ক্লাবপাড়ার ১৭টি ক্যাসিনোর মধ্যে একটির মালিক তিনি। তবে বাকি ১৬টি থেকে তিনি মাসোহারা পেতেন মোটা অঙ্কের। তিনি ইতিমধ্যে ক্যাসিনো কিং নামেই পরিচিতি পেয়েছেন। র‌্যাবের অভিযানে গ্রেফতার খালেদ এখন রিমান্ডে। জি কে শামীমকে বলা হয়ে থাকে টেন্ডার কিং। সাতজন সশস্ত্র দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা করা এই টেন্ডার কিং-এর ওপর আর কেউ নেই। সরকারি দফতরগুলো তার নিয়ন্ত্রণে। তিনি এখন বন্দী। গ্রেফতারের সময় তার কাছ থেকে পাওয়া যায় ১  কোটি ৮০ লাখ নগদ টাকা এবং ১৬৫ কোটি টাকার ওপরে এফডিআর (স্থায়ী আমানত)। র‌্যাবের জালে বন্দী এই টেন্ডার কিং রয়েছেন রিমান্ডে। শফিকুল আলম ফিরোজকে মানুষ কালা ফিরোজ নামেই চেনেন। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গডফাদার কালা ফিরোজ দেশের আন্ডারওয়ার্ল্ডের একজন অন্যতম নিয়ন্ত্রক। বাংলা চলচ্চিত্রেও তিনি অর্থলগ্নি করে থাকেন। বলা হয়ে থাকে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ অপরাধীরা তার হাতের মুঠোয়। পেশায় আদম ব্যবসায়ী আন্ডারওয়ার্ল্ড কিং ঢাকা আর মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া-আসার মধ্যে থাকেন। কলাবাগান ক্লাবে চালাতেন ক্যাসিনো। এই ফিরোজও এখন বন্দী। রয়েছেন রিমান্ডে। তিন সাম্রাজ্যের এই তিন মাফিয়া রিমান্ডে এখন পুলিশি জেরার মুখোমুখি। জেরার মুখে তারা তিনজনই ক্যাসিনো, টেন্ডারবাজি আর আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ে নানা তথ্য দিতে শুরু করেছেন। তারা বলতে শুরু করেছেন, ক্যাসিনো আর টেন্ডারবাজির পেছনে আরও কারা রয়েছেন। তাদের কোন কোন নেতা সহায়তা করতেন এসব কাজে, সেসব নাম বলেছেন একে একে। আর এসব নাম জানতে পেরে পুলিশ হতবাকের পাশাপাশি বিব্রতও হচ্ছে। সূত্রমতে, এমন বেশ কয়েকজনের নাম বেরিয়ে এসেছে, যাদের হয়তো এ বিষয়ে জেরা করাও সম্ভব হবে না। তবে খালেদ আর জি কে শামীম তাদের সব অপকর্মের মূলে দক্ষিণ যুবলীগের একজন নেতার নাম বলেছেন ঘুরেফিরে।

রিমান্ডে থাকা যুবলীগ থেকে সদ্য বহিষ্কৃত নেতা খালেদ পুলিশকে বলেছেন, লিডাররা সাহায্য করতেন ক্যাসিনো চালাতে। পুলিশ কর্মকর্তাদের মাসোহারা দিয়েই চালানো হতো ক্যাসিনো। যে কারণে পাশে থানা থাকলেও তারা সমস্যা করত না।

সাত দেহরক্ষী আর দুইশ কোটি টাকার এফডিআরসহ আটক হওয়া ‘যুবলীগ’ নেতা এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম হয়ে ওঠেন টেন্ডার কিং। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে পাল্টে ফেলা যুবদল থেকে আওয়ামী লীগ হওয়া এই নেতা নিজেকে পরিচয় দেন যুবলীগের সমবায়বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির দায়িত্বে আছেন। উচ্চতায় ছোটখাটো। ৫ ফুটের সামান্য বেশি। মাথায় চুল কম। সাদামাটা গোছের প্রায়। কিন্তু নিরাপত্তা বেষ্টনী তার পুরো রাজকীয়। বিশাল দেহের রক্ষীরা তার পাহারায়। অস্ত্রসজ্জিত দেহরক্ষী নিয়ে তার চলাচল অনেকটাই কমান্ডো স্টাইলের। আগে-পিছে মোটরসাইকেল ও জিপে চড়া রক্ষী বাহিনীর পাহারায় নিকেতনে আসা-যাওয়া করতেন সাইরেন বাজিয়ে। থাকত পুলিশের পাহারাও। যেন রাষ্ট্রীয় কোনো বড় মাপের ভিআইপি মুভমেট করছেন। গোলাম কিবরিয়া শামীমকে শুক্রবার নিকেতনের অফিস থেকে সাত  দেহরক্ষীসহ আটক করে র‌্যাব। নিকেতনের যে অফিস থেকে শামীম র‌্যাবের হাতে ধরা পড়েন তার পুরোটাই আবাসিক এলাকা। আবাসিক ভবনগুলো প্রতিটিই ৬-৭ তলা, একটার সঙ্গে আরেকটা লাগোয়া। শুধু জি কে শামীমের ভবনটি (জি কে বি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড) চারতলা। ভবনটি থেকে কিছু দূরেই রয়েছে মসজিদ। এই ভবনের অফিসে কখনো সকালে, কখনো দুপুরে এমনকি গভীর রাতেও আসতেন জি কে শামীম। সকাল, দুপুর, বিকাল বা রাত যখনই শামীম নিকেতনে ঢুকতেন টের পেয়ে যেতেন আশপাশের সবাই। তার পাহারায় সবসময় তিনটি মোটরসাইকেলে সাতজন দেহরক্ষী থাকতেন।

শামীমের গাড়ির সঙ্গে থাকত আরও দুটি কালো রঙের জিপ গাড়ি। সাইরেন বাজাতে বাজাতে রাস্তা দিয়ে গাড়িবহরসহ এগিয়ে যেতেন শামীম। তার গাড়ি গন্তব্যে (অফিসের সামনে) না পৌঁছানো পর্যন্ত রাস্তায় নামতে পারত না অন্য কোনো গাড়ি। শামীমকে দুই মামলায় ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে পুলিশ। একই সঙ্গে তার সাত দেহরক্ষীর প্রত্যেকে অস্ত্র মামলায় চার দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। গতকাল রাতে ঢাকা মহানগর হাকিম বেগম মাহমুদা আক্তার শুনানি শেষে এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। জি কে শামীমের সাত দেহরক্ষী হলো- দেলোয়ার হোসেন, মুরাদ হোসেন, জাহিদুল ইসলাম, শহীদুল ইসলাম, কামাল হোসেন, সামাদ হোসেন এবং আমিনুল ইসলাম। আন্ডারওয়ার্ল্ড কিং কালা ফিরোজকে নেওয়া হয়েছে ১০ দিনের রিমান্ডে। রাজধানীর কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজকে ধানমন্ডি থানার আলাদা দুই মামলায় ১০ দিন রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দেয় আদালত। গতকাল ঢাকা মহানগর হাকিম বেগম মাহমুদা আক্তার রিমান্ডের এ আদেশ দেন। এর আগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ধানমন্ডি থানার সাব-ইন্সপেক্টর মো. নুর উদ্দিন আসামিকে আদালতে হাজির করে দুই মামলায় ১০ দিন করে মোট ২০ দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন। শুনানি শেষে হাকিম ৫ দিন করে দুই মামলায় মোট ১০ দিন রিমান্ডের আদেশ দেন।

রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, আসামি  দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ অস্ত্র নিজ হেফাজতে রেখে আতঙ্ক সৃষ্টি করে কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের অফিসকক্ষে নিরাপদ আশ্রয় মনে করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজর এড়িয়ে অবৈধ মাদক (ইয়াবা) রেখে ব্যবসা, অসামাজিক কার্যকলাপসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কাজ করে আসছেন। মামলার তদন্তের স্বার্থে আসামির দখল থেকে উদ্ধার অবৈধ অস্ত্র, মাদকদ্রব্যের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন। এ ছাড়া এ আসামির সঙ্গে অপরাধ কর্মকান্ডে  জড়িত সহযোগী আসামিদের বিষয়ে তথ্য, নাম-ঠিকানা ও গ্রেফতারের লক্ষ্যে আসামিকে রিমান্ডে নেওয়া প্রয়োজন। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আজাদ রহমান সাংবাদিকদের জানান, পর্যায়ক্রমে আসামির এই রিমান্ড কার্যকর করা হবে, অর্থাৎ ১০ দিন এই দুই মামলায় খালেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ। এর আগে শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে কলাবাগান ক্রীড়াচক্রে অভিযান চালায় র‌্যাব। সেখান থেকে হলুদ রঙের বিশেষ ধরনের ইয়াবাসহ কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজকে আটক করে র‌্যাব। এ ছাড়া অভিযানে একটি বিদেশি পিস্তল, ক্যাসিনো সামগ্রী ও বিপুল পরিমাণ জুয়া খেলার সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। আটক করা হয় আরও কয়েকজনকে।

সর্বশেষ খবর