সোমবার, ২ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

কয়েক হাজার অস্ত্রের মুখে পতাকা তুললাম

আ স ম আবদুর রব

কয়েক হাজার অস্ত্রের মুখে পতাকা তুললাম

একাত্তরের পুরো মার্চ মাসটি ছিল অগ্নিঝরা।

বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন এই মার্চেই।

সিরাজুল আলম খানের পরিকল্পনায় সাবেক ছাত্রনেতা এবং যুবনেতাদের নিয়ে যে নিউক্লিয়াস গড়ে উঠেছিল, সেই নিউক্লিয়াসের নির্দেশে আমি ২ মার্চ স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করি। পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলা হয়। সেদিন সরকারের তরফ থেকে ছিল কারফিউ। আমরা ঘোষণা করেছিলাম হরতাল। এই হরতাল আর কারফিউর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে লাখো জনতার সমাবেশে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করলাম। করতালিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। পতাকা উত্তোলনের সময় স্লোগান হচ্ছিল- ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’। ‘পাঞ্জাবা না বাংলা- বাংলা, বাংলা, বাংলা। পিন্ডি না ঢাকা- ঢাকা ঢাকা।’ ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ চতুর্দিকে তখন কয়েক হাজার এলএমজি, এসএলআর, ট্যাংক, কামান। ওপরে অস্ত্রসজ্জিত হেলিকপ্টার টহল দিচ্ছিল। যদি একেকটা অস্ত্র থেকে একটা করে গুলিও ছোড়া হতো, কলাভবন প্রাঙ্গণের ঘাসও থাকত না। ভাবলে এখন নিজের কাছেই অবাক লাগে। নিজের জীবনের প্রতি কোনো মায়া ছিল না। পরিবার, মা-বাবা- সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম। ভিতরে ভিন্ন এক উত্তেজনা কাজ করছিল। কারণ সেটা কোনো ক্লাবের পতাকা নয়, সেটা ছিল জাতীয় পতাকা। পতাকা মানে একটা দেশ, একটা জাতি। ২ মার্চ পতাকা উত্তোলন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অবধারিত করা হয়েছিল। স্পষ্ট হয় যে, স্বাধীনতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ হলো। সেদিন আবার জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হলো। শাজাহান সিরাজের ইশতেহার পাঠ যখন শেষ পর্যায়ে, এমন সময় অনির্ধারিতভাবেই বঙ্গবন্ধু এসে হাজির হলেন। উনার আসার কথা ছিল না। এসে বললেন, আমার যা বলার আমি ৭ মার্চ বলব। আন্দোলন, সংগ্রাম, লড়াই অব্যাহত থাকবে। আমরা যে পতাকা উত্তোলন করেছিলাম তাতে যে তিনটি রং ব্যবহার করা হয়েছিল তার অর্থ শুধু যারা পতাকা তৈরি করেছে, নকশা করেছে তারাই জানে। গ্রাউন্ডটা ছিল কালচে সবুজ। এটা বাংলাদেশের গাছ ও ঘাসের রং। ইচ্ছা করেই কালচে সবুজ করেছিলাম। কারণ সবুজ হলো পাকিস্তানের পতাকার রং। আরেকটি ছিল খুনি লাল। রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করব তার প্রতীক। মধ্যখানে বাংলাদেশের মানচিত্রটা হলো সোনালি। পাটের রং থেকে নেওয়া। সারা বিশ্বে তখন বাংলাদেশের সোনালি আঁশ- পাট সুপরিচিত। নিউক্লিয়াসের পক্ষ থেকে ছাত্ররাই এই কাজগুলো করেছে। পতাকা উত্তোলন, পতাকার নকশা, বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারণ, বঙ্গবন্ধুকে স্থপতি উপাধি, বঙ্গবন্ধু উপাধি- সবকিছু। ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান যখন পার্লামেন্ট অধিবেশন বাতিল ঘোষণা করলেন, তখন আমি জগন্নাথ কলেজে ছিলাম। ইকবাল হলে (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছিল আমাদের কন্ট্রোল রুম। একজন টেলিফোন করে বলেছিল আগামীকাল দুপুরের খবরটা শুনবেন, একটা নতুন সংবাদ আছে। কে কোথা থেকে বলেছিল তা আজও জানতে পারিনি। সে তার পরিচয় দেয়নি। একইভাবে আরেকবার টেলিফোন পেয়েছিলাম ২৪ মার্চ রাতে। এরপরই ২৫ মার্চ কালরাত। পাকিস্তানিরা নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ২৩ মার্চ ওরা পাকিস্তান দিবস পালন করত। ওই দিন সারা দেশে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ানো হতো। রাষ্ট্রপতি বা তার প্রতিনিধি সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজে অভিবাদন নিতেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর। ২৩ মার্চ পল্টন ময়দানে মঞ্চ করে পতাকা উত্তোলন হলো। আমার সোনার বাংলা- জাতীয় সংগীত হলো। জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজে আমাদের চারজনকে, অর্থাৎ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের স্যালুট দেওয়া হয়। তখন শুনলাম পাকিস্তানের সঙ্গে একটা চুক্তি হচ্ছে। চার দফা দাবির ওপরে দুই পাকিস্তান এক থাকবে। ভুট্টোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা সফল হয়েছে, শুধু স্বাক্ষর বাকি। ওই দিনই রাত ১টায় আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলাম। বঙ্গবন্ধুকে বললাম, ‘আপনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন না। বাংলাদেশ একটা স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হবে। আপনি সেই রাষ্ট্রের নেতা হবেন।’ আমরা বললাম যে, আমাদের আলাদা পতাকা হবে, আলাদা মুদ্রা থাকবে। এই দাবিগুলো উত্থাপন করার পর পাকিস্তানের সঙ্গে সেই আলোচনাটা ভেঙে যায়।

লেখক : সভাপতি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা ও ১৯৭১ সালে ডাকসু ভিপি। অনুলেখক : শামীম আহমেদ

 

সর্বশেষ খবর