রবিবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

স্মৃতির পাতায় ঊনসত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলো

তোফায়েল আহমেদ

স্মৃতির পাতায় ঊনসত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলো

প্রতিবছর  বাঙালি জাতির জীবনে যখন জানুয়ারি মাস ফিরে আসে তখন ১৯৬৯-এর অগ্নিঝরা দিনগুলো স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে। প্রত্যেক মানুষের জীবনে উজ্জ্বলতম দিন আছে। আমার জীবনেও কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা আছে। ‘ঊনসত্তর’ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কালপর্ব। এ কালপর্বে আইয়ুবের লৌহ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে বাংলার ছাত্রসমাজ ’৬৯-এর ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। জীবনের সেই সোনালি দিনগুলোর প্রতিটি মুহূর্তের কথা মনে পড়ে। অনেক সময় ভাবি, কী করে এটি সম্ভব হয়েছিল!

’৬৬-’৬৭তে আমি ইকবাল হল ছাত্র সংসদের সহসভাপতি এবং ’৬৭-’৬৮তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ তথা ডাকসু’র সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সূতিকাগার। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ’৬০-এর  দশকের গুরুত্ব অনন্য। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ’৪৮ ও ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬ দফা ও ’৬৯-এর ১১ দফা আন্দোলন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু যখন ৬ দফা দিয়েছিলেন আমি তখন ইকবাল হলের (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) সহসভাপতি। ইকবাল হলের সহসভাপতির কক্ষ ছিল ৩১৩ নম্বর। এই কক্ষে প্রায়শই অবস্থান করতেন শ্রদ্ধেয় নেতা শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান এবং আবদুর রাজ্জাক। ৬ দফা দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু দেশব্যাপী ঝটিকা সফরে ৩৫ দিনে ৩২টি জনসভা করেন এবং বিভিন্ন জেলায় বারবার গ্রেফতার হন। বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দেওয়ার পর আমাদের বলেছিলেন, ‘সাঁকো দিলাম স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।’ অর্থাৎ এই ৬ দফার সিঁড়ি বেয়ে তিনি স্বাধীনতায় পৌঁছবেন। বিচক্ষণ নেতা ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে রাজনীতি করেছেন। স্বাধীনতার লক্ষ্য সামনে নিয়েই ’৪৮-এ ছাত্রলীগ, ’৪৯-এ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং মহান ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার বীজ রোপণ করে ৬ দফায় তা প্রতিফলিত করেন। ৬ দফা দেওয়ার পর আইয়ুব-মোনায়েমের নির্দেশে দেশের বিভিন্ন জেলায় বঙ্গবন্ধুর নামে ১০টি মামলা দায়ের করা হয়। প্রতিটি মামলায় জামিন পেলেও দেশরক্ষা আইনে তাঁকে কারাবন্দী করা হয়। শেষবার নারায়ণগঞ্জ থেকে সভা করে ঢাকা আসার পর তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এর প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের ডাকে ৭ জুন দেশব্যাপী সর্বাত্মক হরতালে ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।’৬৮-এর ১৮ জানুয়ারি জেল থেকে মুক্তি পেলেও পুনরায় জেলগেট থেকেই গ্রেফতার করে আগরতলা মামলার ১ নম্বর আসামি হিসেবে অজানা স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথমে আমরা জানতাম না প্রিয় নেতা কোথায় কেমন আছেন। আমরা ছাত্রসমাজ এই গ্রেফতারের বিরুদ্ধে তুমুল গণআন্দোলন গড়ে তুলি। পরে তা আরও তীব্রতর হয়। ’৬৮-এর ১৯ জুন আগরতলা মামলার বিচার যখন শুরু হয়, সেদিন থেকেই আমরা জানতাম আইয়ুব খান রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ তুলে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিকাষ্ঠে মৃত্যুদন্ড দেবে। আইয়ুব খান প্রদত্ত মামলার নামই ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য।’

স্মৃতিকথা লিখতে বসে মনে পড়ছে, ডাকসুসহ চারটি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে ঐতিহাসিক ১১ দফার ভিত্তিতে ’৬৯-এর ৪ জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গড়ে ওঠার কথা। মনে পড়ে ১১ দফা আন্দোলনের প্রণেতা-ছাত্রলীগ সভাপতি প্রয়াত আবদুর রউফ ও সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী; ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) সভাপতি প্রয়াত সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক ও সাধারণ সম্পাদক সামসুদ্দোহা; ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল্লাহ; এবং এনএসএফ-এর একাংশের সভাপতি প্রয়াত ইব্রাহিম খলিল ও সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম মুন্সীর কথা। এ ছাত্রনেতাদের প্রত্যেকেই ছিলেন খ্যাতিমান। আমি ডাকসুর ভিপি হিসেবে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমন্বয়ক ও মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করি। আমার সঙ্গে ছিলেন ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক নাজিম কামরান চৌধুরী। ’৬৯-এর ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ১১-দফা প্রণয়নের পর এটিই প্রথম কর্মসূচি। এর আগে আমরা ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছি। ১৭ জানুয়ারি মাত্র শ পাঁচেক ছাত্র বটতলায় জমায়েত হয়েছিল। ডাকসুর ভিপি হিসেবে আমার সভাপতিত্বে সভা শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে গভর্নর মোনায়েম খান ১৪৪ ধারা জারি করেছে। সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব ছিল সিদ্ধান্ত দেওয়ার ১৪৪ ধারা ভাঙব কি ভাঙব না। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে পুলিশের লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস এমনকি গুলিও চলতে পাওে, গ্রেফতার তো আছেই। জমায়েতে উপস্থিত ছাত্রদের চোখেমুখে ছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দৃঢ়তা। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে শ পাঁচেক ছাত্র নিয়ে রাজপথে এলাম। পুলিশ বাহিনী আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বেপরোয়া লাঠিচার্জ করে। আমরাও সাধ্যমতো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করি। শুরু হয় কাঁদানে গ্যাস আর ফায়ারিং। ছাত্রলীগ সভাপতি আবদুর রউফ ঘটনাস্থলেই আহত হন। আমরা ক্যাম্পাসে ফিরে আসি। পরদিন ১৮ জানুয়ারি পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও ঢাকা শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মঘট পালনের কর্মসূচি দেই। ১৮ জানুয়ারি বটতলায় জমায়েত। যথারীতি আমি সভাপতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট ছিল বিধায় সকালে বটতলায় ছাত্র জমায়েতের পর খ- খ- মিছিল এবং সহস্র কণ্ঠের উচ্চারণ-‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, আইয়ুব খানের পতন চাই।’ গতকালের চেয়ে আজকের সমাবেশ বড়। সেদিনও ১৪৪ ধারা বলবৎ ছিল। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজপথে নেমে এলাম। দাঙ্গা পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ আর টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করল। ফিরে এলাম ক্যাম্পাসে। পরদিন ছিল রবিবার। সে সময় রবিবার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকত। কিন্তু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় খোলা ছিল। কর্মসূচি নেওয়া হলো ১৯ জানুয়ারি আমরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল করব এবং ১৪৪ ধারা ভাঙব। আমরা মিছিল শুরু করি। শুরু হয় পুলিশের বেপোরোয়া লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ। কিন্তু কিছুই মানছে না ছাত্ররা। শঙ্কাহীন প্রতিটি ছাত্রের মুখ। গত দুই দিনের চেয়ে মিছিল আরও বড়। পুলিশ গুলি চালাল। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রলীগের কর্মী আসাদুল হক গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে রাজপথে। বাড়ি দিনাজপুর। ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি শহীদ হন। পুলিশের বর্বরতা ও গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে তাৎক্ষণিকভাবে ২০ জানুয়ারি সোমবার আবার বটতলায় সমাবেশের কর্মসূচি দেই। ২০ জানুয়ারি ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের মাইলফলক। এ দিন ১১ দফার দাবিতে ঢাকাসহ প্রদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। সভাপতির আসন থেকে বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার পরিসর সমাবেশের তুলনায় ছোট। তিন দিনে আমরা সাধারণ ছাত্র ও বিপুল সংখ্যক জনসাধারণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছি। যখন সভাপতির ভাষণ দিচ্ছি তখন মিল-কারখানা, অফিস-আদালত থেকে দলে দলে মানুষ আসছে বটতলা প্রাঙ্গণে। সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্তক্রমে সভাপতির ভাষণে সেদিন বলেছিলাম, “যতদিন আগরতলা মামলার ষাড়যন্ত্রিক কার্যকলাপ ধ্বংস করে প্রিয় নেতা শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীদের মুক্ত করতে না পারবো, ততদিন আন্দোলন চলবে। স্বৈরশাসক আইয়ুব-মোনায়েম শাহীর পতন না ঘটিয়ে বাংলার ছাত্রসমাজ ঘরে ফিরবে না।” পুনরায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঘোষণা দিলাম। লক্ষ মানুষের মিছিল নেমে এলো রাজপথে। কোথায় গেল ১৪৪ ধারা! আমরা ছিলাম মিছিলের মাঝখানে। মিছিল যখন আগের কলাভবন বর্তমান মেডিকেল কলেজের সামনে ঠিক তখনই গুলি শুরু হয়। আমি, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী ও আসাদুজ্জামান একসঙ্গে ছিলাম। আমাদের লক্ষ্য করে এক পুলিশ ইন্সপেক্টর গুলি ছোঁড়ে। গুলি লাগে আসাদুজ্জামানের বুকে। সঙ্গে সঙ্গে ঢলে পড়ে আসাদ। আসাদকে ধরাধরি করে মেডিকেল কলেজের দিকে নেওয়ার পথে আমাদের হাতের ওপরেই সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। একজন শহীদের শেষনিঃশ্বাস স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। মৃত্যু এত কাছে হাতের ওপর! মেডিকেলের সিঁড়িতে আসাদের লাশ রাখা হলো। তাঁর গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত শার্টটি সংগ্রামের পতাকা করে আসাদের রক্ত ছুঁয়ে শপথ গ্রহণ করে সমস্বরে আমরা বলি, “আসাদ তুমি চলে গেছ। তুমি আর ফিরে আসবে না আমাদের কাছে। তোমার রক্ত ছুঁয়ে শপথ করছি, আমাদের দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাবো না।” এরপর ছুটে গেলাম শহীদ মিনার চত্বরে। আসাদের মত্যুর খবর ঘোষণা করলাম শোকার্ত জনতার মাঝে। আসাদের রক্তাক্ত শার্ট সামনে রেখে সমাবেশের উদ্দেশে বললাম, ‘আসাদের এই রক্ত আমরা বৃথা যেতে দেবো না’ এবং ২১ জানুয়ারি পল্টনে আসাদের গায়েবানা জানাজা ও ১২টা পর্যন্ত হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা করি। আমাদের সত্তা ও অস্তিত্ব আসাদের রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ হলো। শহীদ মিনার থেকে শুরু হলো শোক মিছিল। শোক মিছিল মুহূর্তেই লক্ষ মানুষের বিক্ষোভ মিছিলে পরিণত হলো। ইতিমধ্যে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। সেনাবাহিনী, ইপিআর এবং পুলিশ মরিয়া হয়ে ওঠে বিক্ষোভ দমনে। যত্রতত্র গুলি চালাতে থাকে। সেই গুলিতেই শহীদদের তালিকায় যুক্ত হয় মতিউর, মকবুল, আনোয়ার, রুস্তম, মিলন, আলমগীরসহ আরও অনেক নাম। লক্ষ মানুষ নেমে আসে ঢাকার রাজপথে। মানুষের পুঞ্জীভূত ঘৃণা এমন ভয়ঙ্কর ক্ষোভে পরিণত হয় যে, বিক্ষুব্ধ মানুষ ভয়াল গর্জন তুলে সরকারি ভবন ও সরকার সমর্থিত পত্রিকাগুলোয় আগুন ধরিয়ে দেয়। ‘দৈনিক পাকিস্তান’, ‘মর্নিং নিউজ’ এবং ‘পয়গাম’ পত্রিকা অফিস ভস্মীভূত হয়। আগরতলা মামলার প্রধান বিচারপতি এস রহমান তার বাসভবন থেকে এক বস্ত্রে পালিয়ে যায়। নবাব হাসান আসকারি, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য এনএ লস্কর এবং রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধকারী খাজা শাহাবুদ্দীনসহ আরও কয়েক মন্ত্রীর বাসভবনে আগুন দেওয়া হয়।

ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউশনের দশম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমানের লাশ নিয়ে আমরা পল্টনে যাই। লক্ষ লক্ষ মানুষ পল্টনে সমবেত হয়। জানাজা অনুষ্ঠিত হয় পল্টন ময়দানে। বিক্ষুব্ধ জনতা গভর্নর হাউস আক্রমণ করতে চায়। বিনা মাইকে বক্তৃতা করে সংগ্রামী জনতাকে শান্ত করে মতিউরের লাশ নিয়ে পল্টন ময়দান থেকে গণমিছিল নিয়ে আমরা ইকবাল হলের মাঠে আসি। যে মাঠে এসেছিলেন সদ্য-সন্তানহারা শহীদ মতিউরের পিতা জনাব আজহার আলী মল্লিক। তিনি ক্রন্দনরত অবস্থায় বলেছিলেন, ‘আমার ছেলে চলে গেছে দুঃখ নাই। কিন্তু আমার ছেলের এই রক্ত যেন বৃথা না যায়।’ যখন ইকবাল হলে পৌঁছলাম তখনই রেডিওতে ঘোষণা করা হলো- ঢাকা শহরে কারফিউ বলবতের কথা। মতিউরের পকেটে নাম-ঠিকানাসহ এক টুকরো কাগজে লেখা ছিল, ‘মা-গো, মিছিলে যাচ্ছি। যদি ফিরে না আসি মা, মনে কোরো তোমার ছেলে বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য, শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য জীবন দিয়েছে। ইতি- মতিউর রহমান, ১০ম শ্রেণি, নবকুমার ইনস্টিটিউশন। পিতা- আজহার আলী মল্লিক, ন্যাশনাল ব্যাংক কলোনি, মতিঝিল।’ কারফিউর মধ্যেই আমরা মতিউরের লাশ নিয়ে গেলাম ন্যাশনাল ব্যাংক কলোনিতে। আমরা পিতা-মাতার আকুল আর্তনাদের আশঙ্কা করছিলাম। কিন্তু মা শুধু আঁচলে চোখ মুছে বলেছিলেন, ‘আমার ছেলে চলে গেছে দুঃখ নাই! আজ থেকে তুমি আমার ছেলে। মনে রেখো, যে জন্য আমার ছেলে রক্ত দিয়ে গেল, সেই রক্ত যেন বৃথা না যায়।’ শহীদ মতিউরের পিতা ২০১৭-এর ১৭ জুলাই মৃত্যুবরণ করেছেন। মতিউরের কবরেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত। তাঁর কথা সবসময় মনে করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সহযোগিতায় উত্তরায় তাঁর জীবদ্দশায় একটি প্লট দেওয়া হয়। যেখানে ছয়তলা ভবন নির্মিত হয়েছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেখানেই অবস্থান করতেন।

ঊনসত্তরের ২৪ জানুয়ারি গণআন্দোলন-গণবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় গণঅভ্যুত্থান। কারফিউর মধ্যে একদিনও থেমে থাকেনি আমাদের সংগ্রাম। ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভা থেকে স্বৈরশাসকের উদ্দেশে আলটিমেটাম প্রদান করে বলি, ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।’ ২২ ফেব্রুয়ারি তথাকথিত লৌহমানব আইয়ুব খান আমাদের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে বঙ্গবন্ধু মুজিবসহ সব রাজবন্দীকে নিঃশর্ত মুক্তি প্রদানে বাধ্য হয়। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। সেদিন সদ্য কারামুক্ত প্রিয় নেতাকে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ঐতিহাসিক গণসংবর্ধনা প্রদান করা হয়। স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে দিনটির ছবি। এমন একজন মহান নেতার গণসংবর্ধনা সভায় সভাপতিত্ব করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সেদিনের জনসভা ছিল জনসমুদ্র। রেসকোর্স ময়দান কানায় কানায় পরিপূর্ণ। চিরাচরিত প্রথা ভঙ্গ করে আগেই সভাপতির ভাষণ দেওয়ার জন্য লাখ লাখ মানুষকে অনুরোধ জানিয়েছিলাম। ১০ লক্ষাধিক লোক দুই হাত তুলে সম্মতি জানিয়েছিল। বক্তৃতায় আমি বঙ্গবন্ধুকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে বলেছিলাম, “প্রিয় নেতা, তোমার কাছে আমরা ঋণী, বাঙালি জাতি চিরঋণী। কারণ তুমি জেল-জুলুম অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছো। তোমার জীবন তুমি বাঙালি জাতির জন্য উৎসর্গ করেছো প্রিয় নেতা। এই ঋণ আমরা কোনদিন শোধ করতে পারবো না। তাই কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে তোমাকে একটি উপাধি দিয়ে সেই ঋণের বোঝাটা আমরা হালকা করতে চাই।’ ১০ লক্ষাধিক লোক দুই হাত উত্তোলন করে সম্মতি জানানোর পর সেই নেতাকে-যিনি জীবনের যৌবন কাটিয়েছেন পাকিস্তানের কারাগারে, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন-‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তুমুল করতালির মধ্য দিয়ে সেদিন এই প্রস্তাব গ্রহণ করে বাংলার মানুষ লাখ লাখ কণ্ঠে ধ্বনি তুলেছিল, ‘জয় বঙ্গবন্ধু।’

তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল রাজনৈতিক নেতা তৈরির কারখানা। সহনশীল ও পরমতসহিষ্ণু থেকে সামাজিক সম্পর্ক অটুট রেখে আমরা রাজনীতি করেছি। মানুষের সুবিপুল আস্থা আর বিশ্বাস আমাদের ওপর ছিল বলেই দেশব্যাপী তুমুল গণআন্দোলন সংঘটিত করতে পেরেছিলাম। আমরা মানুষের বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়েছি। ২০ জানুয়ারি আসাদের রক্তের মধ্য দিয়ে যে আন্দোলন রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল, সেই আন্দোলনের সফল পরিণতি বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তি, প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকার প্রাপ্তি, ’৭০-এর নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ এবং পরিশেষে ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মহত্তর বিজয় অর্জন। আর এসব অর্জনের ড্রেস রিহার্সেল ছিল ’৬৯-এর অগ্নিঝরা দিনগুলো-যা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে এবং থাকবে চিরদিন।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

[email protected]

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর