শুক্রবার, ৭ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

রোজাদার ঠাট্টা বিদ্রুপ থেকে দূরে থাকে

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

রোজাদার ঠাট্টা বিদ্রুপ থেকে দূরে থাকে

দুনিয়ার সব অশান্তির মূল আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাস ও আখেরাতের প্রতি উদাসীনতা। রমজান আমাদের মনে জাগিয়ে দেয় আল্লাহর ভয়, আত্ম-উপলব্ধি ও পরকালে জবাবদিহির তীব্র অনুভূতি। ফলে কোনো বিশেষ ফোর্স বা দুর্নীতি দমন বিভাগের প্রয়োজন হয় না রোজাদারকে শাসন করার জন্য। রোজাদার আল্লাহর ভয়ে নিজে থেকেই সংযত হয়ে যায়। আরবি সিয়াম মানে বিরত থাকা। আল্লাহর অপছন্দনীয় সব বিষয় থেকে বেঁচে থাকাই হলো আসল সিয়াম। কিন্তু আমরা সিয়ামও করি আবার আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজও করি, তার মানে আমরা যথার্থ সিয়াম পালন করছি না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘ইয়া আইয়্যুহাল্লাজিনা আমানু লা ইয়াসখার কাউমুন মিন কাউমিন আসা আইয়াকুনা খায়রামমিনহুম। অর্থাৎ হে বিশ্বাসীরা! তোমাদের একদল যেন অন্য দলকে উপহাস না করে। হতে পারে যাকে উপহাস করা হচ্ছে সে উপহাসকারীর চেয়ে ভালো।’ আয়াতে ‘লা ইয়াসখার’ মানে হলো ‘সে যেন উপহাস না করে’। এটি নাফি গায়েব মারুফের সিগাহ। ‘ছুখরিয়্যাতুন’ শব্দ থেকে এর উৎপত্তি। বিখ্যাত মুফাসসির ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেন, ‘ছুখরিয়্যাতুন মানে হলো কাউকে নিয়ে এমনভাবে হাসি-ঠাট্টা করা বা হেয় করা যে, ওই ব্যক্তি মনে আঘাত পায়। কিন্তু ব্যক্তি যদি মনে আঘাত না পায় তাহলে সেটি ছুখরিয়্যাত নয় সেটি হবে বা মুজাহাতুন বা কৌতুক। শরিয়ত এ ধরনের কৌতুকের অনুমতি দিয়েছে। (তাফসিরে কুরতুবি ও শরহে জালালাইন।)

ইমাম তিরমিজি (রহ.) শামায়েলে তিরমিজিতে মুজাহ তথা আনন্দদায়ক হাসি-ঠাট্টা সম্পর্কে একটি অধ্যায়ে রসুলের (সা.) হাসি-কৌতুকের বিবরণ দিয়েছেন। মোট ছয়টি হাদিস তিনি উল্লেখ করেছেন। একটির বর্ণনা এ রকম- এক বৃদ্ধা রসুল (সা.) এর দরবারে এসে বলেন, হে আল্লাহর নবী! আপনি দোয়া করুন আল্লাহ যেন আমাকে জান্নাত নসিব করেন। রসুল (সা.) বললেন, কোনো বৃদ্ধা জান্নাতে যেতে পারবে না। এ কথা শুনে বৃদ্ধা যার পর নাই হতাশ হয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। রসুল (সা.) বলেন, হে বৃদ্ধা! তুমি যখন জান্নাতে যাবে তখন তোমাকে যুবতী বানিয়ে জান্নাতে পাঠানো হবে। এ হাদিস উল্লেখ করে মুফাসসিরগণ বলেন, অন্যকে হেয় করা হয় না এ ধরনের কৌতুক সুস্পষ্ট জায়েজ।

বলছিলাম, অন্যকে হেয়প্রতিপন্ন করার কথা। তাফসিরে রুহুল মাআনিতে মুকাতিল (রহ.)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, বনু তামিম গোত্রের লোকদের অভ্যাস ছিল গরিব ও তুলনামূলক পিছিয়ে পড়া সাহাবিদের নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা। হজরত বিলাল (রা.), আম্মার (রা.), সালমান ফারসি (রা.), সুহাইব (রা.), খাব্বাব (রা.), ইবনে নুহাইরা (রা.) এবং সালেম মাওলা হুজায়ফা (রা.) প্রমুখ মর্যাদাবান সাহাবিরা ছিলেন তাদের ঠাট্টার শিকার। একটি সুন্দর সমাজে কেউ কাউকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করবে এমনটি মোটেই মেনে নেওয়া যায় না। তাই আল্লাহতায়ালা আয়াত নাজিল করে বলেছেন, ‘সাবধান! কেউ যেন কাউকে নিয়ে ঠাট্টা না করে।’ (তাফসিরে রুহুল মাআনি ও তাফসিরে আয়াতিল আহকাম)

রসুল (সা.)-এর একজন সাহাবি ছিলেন শ্রবণপ্রতিবন্ধী। তার নাম সাবেত ইবনে কায়েস ইবনে শাম্মাস (রা.)। যেহেতু তিনি কানে কম শুনতেন তাই মসজিদে রসুল (সা.)-এর পাশে বসতেন। একদিন ফজরের সময় তিনি দেরিতে মসজিদে আসেন। নামাজ শেষে অন্যান্য সাহাবিদের ডিঙিয়ে তিনি রসুল (সা.)-এর কাছে এসে বসলেন। এমন সময় একজন সাহাবি তাকে বলল, আপনি এ রকম করছেন কেন, যেখানে জায়গা পান সেখানে বসে পড়ুন। এমন মন্তব্য শুনে সাবেত (রা.)-এর রাগ চড়ে গেল। তিনি বললেন, তোমার নাম কী? সে বলল, আমি অমুক। সাবেত (রা.) বললেন, তোমার মা তো এই দোষে দুষ্ট ছিল। নিজের মায়ের সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য শুনে ওই সাহাবি মারাত্মক মর্মাহত হলেন। মুফাসসির সম্রাট ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এ ঘটনার প্রেক্ষিতে আল্লাহতায়ালা নাজিল করেন- ‘হে বিশ্বাসীরা একদল যেন অন্য দলকে উপহাস না করে। হতে পারে যাকে উপহাস করা হচ্ছে সে উপহাসকারীর চেয়ে ভালো।’ (তাফসিরে ইবনে আব্বাস, প্রথম খ , ৪৩৬ পৃষ্ঠা।)

আসলে কাউকে হেয়প্রতিপন্ন করার মাধ্যমে ভ্রাতৃত্ববোধ নষ্ট হয়। শত্রুতা জেগে ওঠে। সামাজিক শান্তি ক্ষুণ্ন হয়। তাই সুন্দর সমাজ গঠনের লক্ষ্যে আমাদের অবশ্যই অন্যকে হেয় করা, তুচ্ছ-তাছিল্যের অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর এ জন্য মাহে রমজান শ্রেষ্ঠ সময়। কেননা এ সময় মানুষের মন নরম থাকে। অন্যের প্রতি সমমর্মিতা জেগে ওঠে। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দিন। আমিন।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর