মঙ্গলবার, ১৬ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

চিত্রনায়ক ফারুক আর নেই

শোবিজ প্রতিবেদক

চিত্রনায়ক ফারুক আর নেই

অবশেষে মৃত্যুর কাছেই হার মানলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ঢাকা-১৭ আসনের সংসদ সদস্য ও চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ওরফে ফারুক। দীর্ঘদিন রোগে ভুগছিলেন তিনি। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে একটানা চিকিৎসা চলছিল তাঁর। গতকাল সোমবার বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৮টায় সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। খবরটি নিশ্চিত করেছেন নায়ক ফারুকের ভাগ্নি ফৌজিয়া আক্তার লিমা। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। রেখে গেছেন স্ত্রী ও দুই সন্তান।

পাঁচ দশকের বেশি সময়ের ক্যারিয়ারে অভিনয় করেন বহু দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্রে। ১৯৮৭ সালে মুক্তি পাওয়া ফারুকের অভিনীত ‘মিয়াভাই’ চলচ্চিত্রের সাফল্যের পর তিনি চলচ্চিত্রাঙ্গনে ‘মিয়াভাই’ হিসেবে খ্যাতি পান। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ নানা সম্মাননায় ভূষিত হন নন্দিত এই চিত্রনায়ক। অভিনয় থেকে অবসর নেওয়ার পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঢাকা-১৭ আসন থেকে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।

এইচ আকবর পরিচালিত ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রজগতে ফারুকের অভিষেক ঘটে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তি পায় তাঁর অভিনীত প্রথম ছবি ‘জলছবি’। চলচ্চিত্র অঙ্গনে নায়ক ফারুক কিংবা মিয়াভাই নামে পরিচিত হলেও তাঁর আসল নাম আকবর হোসেন পাঠান দুলু। ‘ফারুক’ নামটি মূলত ছিল চলচ্চিত্র অঙ্গনের। অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান, পরিচালক এইচ আকবর ও ফারুক নামে এক বন্ধু মিলে তাঁকে এই নাম দিয়েছিলেন। সেই থেকে ‘ফারুক’ নামেই পরিচিতি পান। ফারুকের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট, কালীগঞ্জে। তবে বেড়ে উঠেছেন পুরান ঢাকাতে। বাবা আজগার হোসেন পাঠানের ছিল পাঁচ মেয়ে ও দুই ছেলে। ফারুক ছিলেন ভাইদের মধ্যে সবার ছোট। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন ফারুক। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ফারুক জানিয়েছেন, ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধ থেকে ফিরে চলচ্চিত্রে মনোযোগ দেন। আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকটি অঙ্গসংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ছিলেন ফারুক। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় খান আতাউর রহমান পরিচালিত ফারুক অভিনীত ‘আবার তোরা মানুষ হ’। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পায় নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘লাঠিয়াল’। এ ছবিতে ফারুকের চরিত্রটি সাড়া ফেলে। সে সময় থেকে গ্রামীণ পটভূমির চলচ্চিত্রে তাঁর আলাদা পরিচিতি পান তিনি। একই বছর মুক্তি পায় খান আতার আরেক সিনেমা ‘সুজন সখী’। গ্রামীণ পটভূমির গল্পে নির্মিত এ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র গ্রামীণ তরুণ সুজনের ভূমিকায় ফারুকের নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। পরের বছর ১৯৭৬ সালে মুক্তি পায় আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমণি’। এটিও সাড়া ফেলে। ১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় শহীদুল্লাহ কায়সারের কালজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে আবদুল্লাহ আল মামুনের সিনেমা ‘সারেং বৌ’। সিনেমায় ‘কদম সারেং’ চরিত্রে জীবনঘনিষ্ঠ অভিনয়ের জন্য ক্ল্যাসিক অভিনেতা হিসেবে গণ্য হন। আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ছবিতে মিলন চরিত্রে ফারুকের অভিনয় দর্শকমনে দাগ কাটে। তার অভিনীত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে- ঝিনুকমালা, কথা দিলাম, নদের চাঁদ, জনতা এক্সপ্রেস, দিন যায় কথা থাকে, সাহেব, নাগরদোলা, মাটির পুতুল, ছোট মা, এতিম, তৃষা, ঘর জামাই, মাটির মায়া, সূর্যগ্রহণ, সখী তুমি কার। ২০২১ সালের ৪ মার্চ সিঙ্গাপুরে যান ফারুক। চেকআপের পর তখন তার ইনফেকশন ধরা পড়লে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি হন এই অভিনেতা। এরপর থেকে সেখানেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন ফারুক। মরহুম ফারুকের লাশ আজ সকাল ১০টায় বিমানযোগে দেশে আসার কথা রয়েছে বলে জানিয়েছেন তার পুত্র শরৎ পাঠান। শরৎ আরও জানান, এরপর উত্তরার বাসভবন, এফডিসি, সংসদভবন এলাকা ও শহীদ মিনারে নামাজে জানাজা গ্রামের বাড়ি কালীগঞ্জে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হবে তাঁকে। এদিকে, ফারুকের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘চিত্রনায়ক ফারুকের মৃত্যু দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্র দেশের সমাজ ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। চলচ্চিত্র অঙ্গনে তাঁর অবদান দেশের মানুষ আজীবন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।’ রাষ্ট্রপতি আকবর হোসেন পাঠান ফারুকের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। অন্যদিকে, সংসদ সদস্য ও চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ফারুকের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক শোক বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়। তাঁর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এমপি, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম প্রমুখ। অন্যদিকে চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতি অঙ্গনের বিভিন্ন সংগঠনও অভিনেতা ফারুকের মৃত্যুতে গভীর শোক ও তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেছে।

এক সারেং এর গল্প

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর